ডোনেশন করুন
ধন্যবাদ!
আমরা আপনার উদার দানের প্রশংসা করি। আপনার সমর্থন আমাদের উৎসাহিত করেছে!
প্রথম কথাঃ কুয়াশার রহস্য সম্পর্কে জানব আজকের লেখাতে। বাংলাদেশের সব থেকে শীতলতম মাস হল জানুয়ারি মাস। শীতের সকালের প্রতিটা দিনই হয় কুয়াশাময়। এমনকি বিকেল বেলায়ও কিছু কিছু কুয়াশা থাকে। শীতের দিনে সন্ধ্যার পর থেকেই কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে আসে চারিদিক। রাত যত গভীর হয় কুয়াশা তত ঘন হয়।
শীতের সকালে চারিদিক ঘিরে থাকে শিশির। ঘাসের ডগায়, গাছের পাতায়, সবজির ক্ষেতের প্রতিটা গুল্মের পাতায় পাতায় থরে থরে সাজানো থাকে শিশিরের বিন্দু। কুয়াশার ঘনত্ব যত বেড়ে যায় দূরের দৃশ্য তত ঝাপসা হয়ে আসে। প্রবল ঠান্ডা নামলে দেখা দেয় শৈত্যপ্রবাহ। শীতের সকালে দেখা যায় শিশির জমে ফোঁটা ফোঁটা আকারে প্রতিটা পাতার নিচে তা ঝুলতে থাকে, দুলতে থাকে। আর কিছু ফোঁটা আকারে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে মাটির সাথে মিশে যায়। কিন্তু কি এই শিশির বা কুয়াশা? গরমের আবহাওয়াতে তো এই কুয়াশা দেখা যায় না! তবে শীতে কেন কুয়াশা নামে? চলুন জেনে নেওয়া যাক কুয়াশার রহস্য।
কুয়াশার রহস্যঃ কুয়াশা আসলে কি?
বাতাসে মিশে থাকা জলীয় বাষ্প ঠান্ডা বায়ুর সংস্পর্শে এসে যখন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা আকারে জমে যায় এবং অসংখ্য পরিমাণ এইরকম জলীয়বাষ্পের কণা একসঙ্গে যে ধোঁয়াশার সৃষ্টি করে তাই কুয়াশা। অর্থাৎ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকণা ঠান্ডা বায়ুর সংস্পর্শে জমাট বেঁধে কুয়াশার সৃষ্টি করে। কুয়াশার রহস্য মুলত এটাই। আকাশে আমরা যে মেঘমালাকে দেখি আংশিকভাবে তাও কিন্তু কুয়াশা।
কুয়াশা কিভাবে তৈরি হয়?
একটি উদাহরণ এর সাহায্যে আমরা বোঝার চেষ্টা করি কুয়াশা তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়া।
আমরা জানি শীতকালে বায়ু সাধারণত শুষ্ক প্রকৃতির হয়। অর্থাৎ শীতের বাতাসে আদ্রতা তেমন একটা থাকে না। এবং খুব সকালবেলা এবং রাত্রের দিকে এই বায়ু প্রচন্ড পরিমাণে শীতল থাকে।
ঠিক একই সময়ে আমাদের শরীরের অভ্যন্তরে যে জৈব উত্তাপ সেটি বিরাজমান থাকে।(সাধারণত আমাদের শরীর অভ্যন্তরের তাপমাত্রা সর্বদাই ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ৯৮.৫° ফারেনহাইট এর কাছাকাছি থাকে। শীত অথবা গ্রীষ্ম অথবা বর্ষা কোন আবহাওয়াতেই এটির তারতম্য তেমন একটা হয় না) এই অবস্থায় আমরা বায়ুমণ্ডল থেকে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে যে বায়ু গ্রহণ করি এই বায়ুটি দুটি পরিস্থিতি পার করে। বায়ু যখন বাইরে থাকে তখন তা শুষ্ক এবং শীতল থাকে। তবে যখন বায়ু শ্বাস গ্রহণের মাধ্যমে শরীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করল তখন আমাদের শরীরের জৈব উত্তাপ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তা কিছুটা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
এবার যখন আমরা শ্বাস ত্যাগ করি তখন বেরিয়ে আসে উত্তপ্ত বায়ু। এবং ওই বায়ুর সঙ্গে মিশে থাকে আদ্রতা বা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকণা। এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকনা মিশ্রিত উষ্ণ বায়ু যখন শুষ্ক ও শীতল বায়ুর মুখোমুখি হয় তখন নিঃশ্বাস দ্বারা ত্যাগ করা বায়ুর ভেতর থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকণাগুলো খুব অল্প সময়ের ভেতরেই ঐ ঠান্ডা বায়ুর প্রভাবে জমে যায়। এই জমে যাওয়া জলকণা গুলোই মূলত দৃশ্যমান হয় কুয়াশার আকারে। অর্থাৎ আমরা কুয়াশার আকারে যা দেখতে পাই তা শুধুই জমে যাওয়া জলকণা ছাড়া আর কিছু নয়।
ঠিক এভাবেই শীতের বাতাসে থাকা জলকণাগুলো ঠান্ডা ও শুষ্ক বাতাসের প্রভাবে জমে গিয়ে বায়ুমন্ডলে কুয়াশার সৃষ্টি করে। আর এটাই কুয়াশার রহস্য!
শুধু শীতকালেই কুয়াশা দেখা যায় কেন?
যেহেতু জমে যাওয়ার ফলেই জলকণাগুলো কুয়াশা আকারে দৃশ্যমান হয় তাই অবশ্যই কুয়াশার ক্ষেত্রে ঠান্ডার একটি প্রভাব থাকতেই হবে। গরমের উত্তাপে কখনোই জল জমাট বাঁধে না। এই কারণেই আমাদের শরীরের অভ্যন্তরের জৈব উত্তাপ এবং বাইরের আবহাওয়ার পরিবেশগত উত্তাপের পার্থক্য যত বেশি হবে ততই এই কুয়াশার দৃশ্যমানতা বেশি হবে। বাইরের আবহাওয়া যত বেশি গরম থাকবে কুয়াশা তৈরীর এই ব্যাপারটি ততই দূর হয়ে যাবে। এই কারণে শুধুমাত্র শীতকালেই কুয়াশা দেখা যায় এবং গরমকালে কখনও আমরা কুয়াশা দেখতে পাই না। অথবা এমনকি শীতের দিনেও যেদিন আবহাওয়া তুলনামূলক বেশি উত্তপ্ত থাকে সেদিন কুয়াশার পরিমাণও কম হয়ে থাকে। মূলত তাপমাত্রার তারতম্য, বাতাসের আদ্রতা, এবং বায়ু প্রবাহের গতি এই তিনটি বিষয়ের উপরেই কুয়াশার অস্তিত্ব নির্ভর করে।
মাটির কাছাকাছি সব থেকে বেশি কুয়াশা জমে কেন?
শীতকালের এই কুয়াশা বা শিশির মাটির কাছাকাছিই সব থেকে বেশি জমতে দেখা যায়। একটা বড় উঁচু বৃক্ষের উপরের দিকের পাতায় যতটা না শিশির জমে তার থেকে নিচের দিকে মাটির কাছাকাছি থাকা পাতায় শিশির বেশি জমে। এর কারণ হলো, মাটির কাছাকাছি অঞ্চলের বায়ু অধিক পরিমাণে শীতল থাকে।
শীতকালে সমস্ত দিন সূর্যের উত্তাপে মাটি গরম হয়। কিন্তু রাত্রিবেলা বিকিরণের মাধ্যমে প্রকৃতির মাঝে তাপ নিষ্কাশন করে মাটি শীতল হয়ে যায়। ফলে এই শীতল মাটির কাছাকাছি অঞ্চলের বায়ু অধিক ঠান্ডা ভাব ধারণ করে। আর ঠান্ডার কাছাকাছি অঞ্চলেই শিশির বেশি জমে তা তো আমরা পূর্বেই জেনেছি।
কুয়াশার প্রভাবে ক্ষতি হয় কি?
বিচিত্র এই জগত। বিচিত্র তার ভাব, বিচিত্র তার ভাষা। প্রকৃতির এই বিচিত্রতার এক সুন্দর বহিঃপ্রকাশ হল কুয়াশা। এই কুয়াশা এক অনিন্দ্য সৌন্দর্যও বটে! তবে এর কিছু ক্ষতিকর প্রভাবও থাকতে পারে যেমন-
১) শীতের সকালে বা কুয়াশাযুক্ত রাত্রিতে, কুয়াশার কারণে চারিদিকে যখন খুব একটা দেখা যায় না ধোয়া ধোয়া বা ঝাপসা দেখা যায় তখন রাস্তাঘাটে গাড়ি চলাচল করা কঠিন হয়ে পড়ে। কখনও কখনও দীর্ঘ সময় যাবৎ রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখতে হয়। কখনো কখনো দুর্ঘটনাও ঘটে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে এই কুয়াশার কারণে। সড়ক পথ, রেলপথ এবং বিমানপথ প্রত্যেকটা যাতায়াত মাধ্যমেই এই সমস্যা তৈরি হয়ে থাকে।
২) অতিরিক্ত কুয়াশার কারণে কিছু ক্ষেত্রে ফসলের ক্ষতি হয়ে থাকে। আলু, টমেটো, সরিষা, সিম, পান ইত্যাদি ফসল মাত্রাতিরিক্ত কুয়াশার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কিছু সবজির বীজতলাতে অঙ্কুরিত ছোট চারা গুলো ‘কোল্ড ইনজুরি’র শিকার হতে পারে।
৩) শীতের কুয়াশায় কারো কারো ক্ষেত্রে এলার্জিজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে। অনেকের শীতের সময় শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। এছাড়াও শীতে কারো কারো ক্ষেত্রে চোখের সমস্যা ঠোঁট ফাটা ইত্যাদি সমস্যা প্রবল হতে পারে। অধিক্ষণ শরীরে কুয়াশা লাগালে এমনকি ঠান্ডাজনিত নানা রোগলক্ষণ দেখা দিতে পারে।
তুষার কেন হয়?
ভূমির সংস্পর্শে থাকা মেঘমালা বা কুয়াশা প্রচন্ড ঠান্ডায় আরও অধিক ঘনীভূত হয়ে বা জমে গিয়ে তুষারের সৃষ্টি করে। পৃথিবীতে কিছু কিছু শীত প্রধান অঞ্চল আছে যেখানে বছরে ছয় মাসেরও অধিক সময় যাবত কুয়াশায় ঢাকা থাকে। যেমন ক্যালিফোর্নিয়া, আর্জেন্টিনা, আটলান্টিক মহাসাগরের নিউফাউন্ডল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের উপকূল এলাকা, ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জি, লন্ডন, রেয়স ও লাব্রাডর ইত্যাদি স্থানে খুব বেশি পরিমাণে কুয়াশা পড়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াতে ‘সিয়েরা নেভাদা’ এই পর্বতমালায় প্রচুর পরিমাণে তুষার পড়ে। এই কারণে এই অঞ্চলে অনেক ‘স্কি রিসোর্ট’ তৈরি করা হয়েছে। উটা এবং কলোরাডো রাজ্য দুটিতেও প্রচুর পরিমাণে তুষারপাত হয়ে থাকে।
তাপ বিকিরণ দ্বারা বস্তু কিভাবে শীতল হয়?
প্রথমে একটি উদাহরণ দেখে নেওয়া যাক। একটি ধাতব পাত্র শীতের রাত্রে খোলা পরিবেশে রাখলে সকাল বেলায় আমরা দেখি তাতে শিশির জমে গেছে। অর্থাৎ রাত্রির শীতল পরিবেশে ধাতব পাত্রটি তাপ বিকিরণ দ্বারা নিজেকে আরও শীতল করেছে। এবং এই শীতলতার স্পর্শে জলকণাগুলো জমে গিয়ে কুয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। বিকিরণ হলো এমন একটি পরিস্থিতি যখন কোন বস্তু তার অভ্যন্তরের শক্তি(আলো, তাপ, রেডিও তরঙ্গ, রঞ্জন রশ্মি), তরঙ্গ বা কণার মাধ্যমে উন্মুক্ত পরিবেশে ছড়িয়ে দেয়। শীতকালে অধিক শীতল বস্তুর গায়েই শিশির জমার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
শেষ কথাঃ সৌন্দর্য এবং বিচিত্রতার বার্তা বয়ে নিয়ে আসা শীতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এই শিশির প্রকৃতিকে করে তোলে মধুময়! সহজাত জীবনযাত্রায় কিছু নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করলেও সামগ্রিক বিবেচনায় তা এই জীবনেরই অংশ। আর বিজ্ঞান দ্বারা যখন জানতে পারছি কুয়াশার রহস্য বা শিশিরতত্ত্ব তখন তা হয়েছে আমাদের আরও পরিচিত আপনজন! ভালোবাসা রইলো কুয়াশার প্রতি!
আরো পড়ুনঃ ঠোঁট ফাটা প্রতিরোধের উপায়: কারণ, লক্ষণ ও জটিলত
ডা. দীপংকর মন্ডল
রেজিস্টার্ড হোমিওপ্যাথ
০৪.০১.২০২৫
এই লেখাটি আপনার উপকারে এসেছে কি? আরো নতুন লেখা তৈরির জন্য আর্থিকভাবে অবদান রাখতে পারেন। যেকোন পরিমাণ আর্থিক কন্ট্রিবিউশন করতে নীচের ডোনেট বাটন ব্যাবহার করুন।