শরীরচর্চার পাশাপাশি সঠিক খাদ্যাভ্যাসের গুরুত্ব নিয়ে আজকের ব্লগ আর্টিকেল। শরীরকে সুস্থ, রোগমুক্ত, ফিট রাখতে এবং সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু লাভ করতে নিয়মিত শরীর চর্চা অনুশীলনের কোন বিকল্প নেই এটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে শরীর চর্চা অনুশীলন করার পাশাপাশি সঠিক খাদ্যাভ্যাসের চর্চাও যদি আমরা না করি তাহলে আমরা যথার্থ উপকার পাবো না। তাই শরীরচর্চার পাশাপাশি পুষ্টিমান সমৃদ্ধ খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলাও অত্যন্ত দরকারি। সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং শরীর চর্চা এই দুটি বিষয়ের সমন্বয় সাধন করতে পারলেই আমরা যথাযথ ফল লাভ করতে পারব। আজকের লেখাতে আমি শরীরচর্চা এবং আদর্শ খাদ্যভ্যাস এর গুরুত্ব বিষয়ে আলোচনা করব এবং তার সাথে সাথে একটি সুষম খাদ্যের তালিকা প্রকাশ করব।
আমরা জানি, যে কোন কাজেই শক্তির প্রয়োজন হয়। একটি মোবাইল ফোন চালাতে যে শক্তির প্রয়োজন তা মোবাইলের ব্যাটারি তাকে প্রদান করে। একটি গাড়ি চলতে যে শক্তির প্রয়োজন তা সেই গাড়ির ব্যাটারি বা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত তেল থেকে পাওয়া যায়। ঠিক সেই রকম ভাবে জীবদেহে বা মানুষের শরীরে শক্তির যোগান এর প্রধান উৎস হল খাদ্য। আর স্বাস্থ্যকর ও সঠিক খাদ্যাভ্যাস হলো সেই ধরনের খাদ্যাভ্যাস যা জীবের সামগ্রিক সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে এবং স্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনে সহায়তা করে থাকে।
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের উপকারিতার বিষয়ে এখন আমি আলোচনা করব।
শক্তি বৃদ্ধিঃ শরীর চর্চা করার সময় আমাদের শরীর থেকে মেদ, গ্লাইকোজেন, প্রোটিন ইত্যাদি ক্ষয় হয়। এই কারণে শরীর চর্চা করার সাথে সাথে কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার পরিমিত মাত্রায় গ্রহণ করলে শরীরের এই ক্ষয় পূরণ হয় এবং দীর্ঘক্ষন যাবত শরীর চর্চা করা সম্ভব হয়। এবং সামগ্রিকভাবে আমরা সফলতা লাভ করি।
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বা হেলদি লাইফস্টাইল আমাদের শরীরে যেমন পুষ্টি যোগান দেয় তেমনি নানাবিধ অসংক্রামক রোগ (যেমন হার্টের রোগ, স্ট্রোক, ক্যান্সার, ফুসফুসের রোগ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি) থেকে সুরক্ষা দেয়, ওজন নিয়ন্ত্রণ করে ও স্বাস্থ্যঝুঁকি কমায়।
পেশী গঠন ও মেরামতঃ পর্যাপ্ত পুষ্টি গ্রহণ না করে দীর্ঘক্ষণ যাবৎ ব্যায়াম করলে এমনকি আমাদের পেশীর প্রোটিনও ভাঙতে পারে (গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়ায়)। তাই পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিন গ্রহণ করলে ও সঠিক খাদ্যাভ্যাসের চর্চা করলে পেশীর প্রোটিন ক্ষয় কম হয়। আমাদের পেশি গঠনের মূল উপাদান হলো প্রোটিন। তাই আমরা যেহেতু আমাদের পেশীকে বিল্ড আপ করতে চাই তাই অবশ্যই শরীর চর্চার পাশাপাশি পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে।
কোষের ক্ষতি পুনরুদ্ধারঃ শরীর চর্চার কারণে আমাদের কোষের যে ক্ষয় হয় তা সঠিক খাবার খাওয়ার মাধ্যমে দ্রুত পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়। ভিটামিন, মিনারেল এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার কোষের ক্ষতি দ্রুত পূরণ করতে সহায়তা করে এবং শরীরের প্রদাহ কমায়।
ওজন নিয়ন্ত্রণ করাঃ সঠিক খাদ্যাভ্যাসের কারণে শরীরে অতিরিক্ত মেদ জমতে পারে না এবং আমাদের মাসেল এর গঠন হয় ফলে শরীরের ভারসাম্য বজায় থাকে। পরিমিত খাদ্যাভ্যাস দ্বারা ওজন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। পর্যাপ্ত পরিমাণে ফাইবার সম্মিলিত খাবার খেলে দীর্ঘক্ষণ তা পেটে থাকে এবং খাবার গ্রহণের প্রবণতা কম হয়।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিঃ ভিটামিন ও মিনারেল আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং শরীরকে বিভিন্ন সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে থাকে। আর এ ভিটামিন ও মিনারেল পর্যাপ্ত পরিমাণে সুষম খাদ্যাভ্যাস থেকে আমরা পেয়ে থাকি।
হাড়ের স্বাস্থ্যরক্ষাঃ আর যদি শক্ত ও মজবুত হয়ে থাকে তবে শরীরচর্চার সময় সাধারণত চোট লাগার ঝুঁকি কম হয়। হাড়কে শক্ত মজবুত করে থাকে ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন ডি। তাই শরীরে যেন যথেষ্ট পরিমাণ ভিটামিন ডি এবং ক্যালসিয়ামের যোগান থাকে সেদিকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে।
বয়স লিঙ্গ শারীরিক কার্যকলাপের মাত্রা এবং শারীরিক অবস্থা ইত্যাদি নানাবিধ কারণে সুষম খাদ্যের তালিকা এবং তার পরিমাণ ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। সুষম খাদ্যের একটি সাধারণ তালিকা এখানে দেওয়া হলোঃ
শস্য ও শস্যজাত দ্রব্য (Carbohydrates)- ঢেকি ছাটা চাল বা লাল আবরণ যুক্ত চাল, আটা, ওটস, বার্লি, ভুট্টা, ব্রাউন ব্রেড ইত্যাদি কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট খাবারের উদাহরণ। এই খাবারগুলো ধীরে ধীরে হজম হয় ফলে দীর্ঘক্ষণ ক্ষুধা লাগে না। খাবারগুলো শরীরের শক্তি যোগায়। এছাড়াও কিছু সরল কাইবো কার্বোহাইড্রেট যুক্ত খাবার যেমন মধু, ফল ইত্যাদি প্রাকৃতিক উৎস থেকে পাওয়া যাবে। তবে চিনি এবং মিষ্টি খাবার না খাওয়াই ভালো।
প্রোটিন (Protein)- দুই প্রকার উচ্চ থেকে আমরা প্রোটিন খাবার পেতে পারি উদ্ভিজ উৎস এবং প্রাণিজ উৎস।
উদ্ভিজ্জ প্রোটিনঃ ডাল, সয়াবিন, মটরশুঁটি, টফু, বাদাম, বীজ এই সকল খাবারগুলো প্রোটিন এর উদ্ভিজ উৎস।
প্রাণিজ প্রোটিনঃ মাছ, ডিম, মুরগি, চর্বিহীন মাংস, দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য (পরিমিত পরিমাণে) ইত্যাদি প্রাণিজ প্রোটিনের উৎস।
ফল ও সবজি (Fruits and Vegetables)- বিভিন্ন রঙীন ফল ও সবজিঃ বিভিন্ন রকমের রংবেরঙের ফল থেকে ভিটামিন, মিনারেল এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের পাওয়া যায়। প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে ফল ও সবুজ শাকসবজি যেমন গাজর, টমেটো, কমলা, আপেল, কলা, শসা, কুমড়া, লাউ, উচ্ছে, শাক, পালং শাক, পুঁইশাক এই সকল খাবার থেকে পরিণত পরিমাণে গ্রহণ করা উচিত।
স্বাস্থ্যকর ফ্যাট (Healthy Fats)- ডায়েট প্লান এ অ্যাভোকাডো, বাদাম, বীজ, জলপাই তেল, মাছের তেল (ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড) ইত্যাদি থাকলে তা থেকে আমরা প্রচুর পরিমাণে স্বাস্থ্যকর ফ্যাট পেতে পারি। এই স্বাস্থ্যকর ফ্যাট শরীর গঠনে সহায়তা করে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। তবে স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও ট্রান্স ফ্যাট যুক্ত খাবার যেমন প্রক্রিয়াজাত খাবার ফাস্টফুড জাঙ্ক ফুড তেলেভাজা খাবার ইত্যাদি স্বাস্থ্যের জন্য প্রচন্ড ক্ষতিকর তাই যথাসম্ভব এসব এড়িয়ে যেতে হবে।
দুগ্ধজাত দ্রব্য (Dairy Products)- কম চর্বিযুক্ত দুধ, দই, পনির: ক্যালসিয়াম ও প্রোটিনের খুব ভালো উৎস। কারো কারো ক্ষেত্রে এই সকল দুধ এবং দুগ্ধ্বজাত খাবার অসহ্য(ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স) হতে দেখা যায়। এইরকম সমস্যা থাকলে লোকদের যত খাবারের বিকল্প উৎস যেমন ছায়া দুধ কাঠ বাদামের দুধ ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে।
পর্যাপ্ত পরিমাণে জলঃ প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান করা সকলের জন্য অপরিহার্য। কেননা আমাদের শরীর গঠনের মোট উপাদানের ৬০ শতাংশই হলো জল। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সচল রাখতে, শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং শরীরের বিভিন্ন বিপাকীয় কর্মকাণ্ডে এবং কিছু রাসায়নিক বিক্রিয়ায় জলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। শরীর চর্চা করার সময় যেহেতু শরীর প্রচুর ঘেমে যায় তাই এই সময় জলের চাহিদা আরো বেড়ে থাকে। জিহাইড্রেশন যেন আমাদের শারীরিক কাজকর্মে বাধা না হতে পারে এই কারণে শরীরচর্চার পর পর্যাপ্ত পরিমাণ জল পান করতে হবে।
প্রতিদিন আহারে গ্রহণ করা খাবারে যেন খাদ্যের ছয়টি উপাদান যথাযথভাবে বিদ্যমান থাকে সেদিকে নজরে রাখতে হবে। এই কারণে খাদ্য তালিকায় বিভিন্ন ফুট গ্রুপের খাবার অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
প্রক্রিয়া যাতে বিভিন্ন খাবার চিনিযুক্ত পানীয় এবং অতিরিক্ত তেল মসলাযুক্ত রাজসিক খাবার সবসময়ই এড়িয়ে যাওয়া উচিত।
একবারে অধিক খাবার না খেয়ে বরং দিনের ভেতর বিভিন্ন সময়ে অল্প অল্প করে বারবার খাবার গ্রহণের অভ্যাস করা ভালো।
খাবার ধীরে ধীরে খাওয়া উচিত এবং যথা সম্ভব চিবিয়ে নরম করে খাবার খেতে হবে। খাওয়ার সময় খুব ব্যস্ত ত্রস্ত হয়ে খাওয়া উচিত নয়।
খাবারের পরিমাণ নির্ধারণ করতে শরীরের চাহিদাকে গুরুত্ব দিতে হবে। অর্থাৎ শরীরে যে পরিমাণ চাহিদা থাকবে সেই অনুযায়ী খাবারের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে।
এবং অবশেষে একটি বিষয় অবশ্যই মনে রাখতে হবে শারীরিক কোন ত্রুটি বা অসুবিধা থাকলে অবশ্যই সে ক্ষেত্রে একজন ডাইটেশিয়ান বা পুষ্টিবিদের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী সঠিক খাবারের রুটিন তৈরি করতে হবে।
শেষ কথাঃ শরীরচর্চার মাধ্যমে আমাদের শরীর শক্তিশালী ও বলবান হয়। শরীরের গঠন সুনিয়ন্ত্রিত হয়। আর সঠিক খাদ্যাভ্যাস আমাদের সুস্বাস্থ্য অর্জন ও সুস্বাস্থ্য ধরে রাখার কাজকে সহায়তা করে। আমরা যদি নিয়মিত শরীর চর্চা করি এবং একটি সুষম খাদ্য তালিকা নিয়মিত অনুসরণ করি তবে আমরা সুস্থ সুন্দর ও রোগ মুক্ত জীবন যাপন এর আশা করতে পারি। তাই শরীরচর্চার পাশাপাশি অবশ্যই সঠিক ও সুষম খাদ্যাভ্যাসের উপর গুরুত্ব দিতে হবে।
ডা. দীপংকর মন্ডল।
রেজিস্টার্ড হোমিওপ্যাথ।
১৫.০৪.২০২৫