নিত্য ব্যবহৃত নাক্স ভমিকা ঔষধটি হোমিওপ্যাথিক মেটেরিয়া মেডিকার একটি রত্ন বিশেষ। নানাবিধ রোগ লক্ষণে ঔষধটি আমাদের প্রতিনিয়ত ব্যবহার করতে হয়। এটি একটি শীতকাতর শ্রেণীর ঔষধ এবং ক্রনিক রোগে ঔষধটি লক্ষণ অনুযায়ী ব্যবহারে ভালো ফল পাওয়া যায়। ঔষধটি সর্বপ্রথম প্রুভিং করেন এবং হোমিওপ্যাথিতে প্রচলন করেন যিনি তিনি হচ্ছেন হোমিওপ্যাথির জনক মহাত্মা শ্যামুয়েল হানিম্যান।
নাক্স ভমিকা ঔষধ পরিচিতিঃ
নাক্স ভমিকা ঔষধটি কচিলা গাছের বীজ থেকে তৈরি হয়। ঔষধটির সাধারণ নাম হলো পয়জন নাট(Poison Nut).
সংক্ষিপ্ত নামঃ Strychnos nux vomica
সংক্ষিপ্ত নামঃ Nux v.
ক্রিয়াঃ পলিক্রেস্ট ঔষধ।
ধরনঃ নতুন এবং পুরাতন সকল প্রকার রোগে ব্যবহৃত হয় ঔষধটি।
কাতরতাঃ প্রচন্ড শীত কাতর। ঠান্ডা বাতাসে খুবই সংবেদনশীল।
মেডিসিন কিনোটসঃ
প্রচন্ড শীতকাতর রোগী। ঠান্ডাতে সকল কষ্টের বৃদ্ধি। বারংবার নিষ্ফল মল বেগ। বাথরুমে যায় কিন্তু বাথরুম ক্লিয়ার হয় না। জ্বরের প্রত্যেকটা স্টেজে শীত থাকে খুব। অর্থাৎ জ্বরের শুরুতে, জ্বর কালীন এবং জ্বর ত্যাগের পরেও রোগী শীত অনুভব করে।
ফাংশনালিটিঃ
নাক্স ভমিকা হোমিওপ্যাথিক ঔষধ টি নানাবিধ রোগের উপরে সফলভাবে ব্যবহৃত হয়। যেমন- গ্যাস্ট্রাইটিস, কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়াবেটিস, ডাইজেস্টিভ ডিসঅর্ডার, অনিদ্রা, বাত বেদনা, জ্বর, সর্দি-কাশি, মাথাব্যথা, হিক্কা, হার্টের রোগ, পাইলস, ডায়রিয়া, আমাশয়, আইবিএস, আলসার, জ্বালাপোড়া, পেট বেদনা, মূত্র থলিতে বেদনা, নার্ভাস সিস্টেম ডিজঅর্ডার, ডিপ্রেশন রিলিফ, হার্নিয়া, মাইগ্রেনের ব্যথা, ফুসফুসের রোগ, লিভারের রোগ, কিডনি রোগ, রক্তশূন্যতা ইত্যাদি।
রোগী ঈর্ষাকাতর, বদরাগী, সহজেই রেগে যায়। সেই সকল লোক যারা নিয়মিত অধিক পরিমাণে মসলাযুক্ত গুরুপাক খাবার খায়, মাদক সেবন করে, রাত জাগার অভ্যাস আছে তাদের রোগ-লক্ষণে ঔষধটি ব্যাবহৃত হতে পারে। বিভিন্ন অ্যারোমেটিক ঔষধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দ্বারা সৃষ্টি হওয়া রোগের ক্ষেত্রেও ঔষধটি অধিক উপযোগী।
নাক্স ভমিকার ক্রিয়াকালঃ
১ থেকে ৭ দিন অথবা ১৫ থেকে ২০ দিন।
শক্তিঃ ১ থেকে ২০০ বা ১০০০ শক্তি(১এম) এবং তদূর্ধ উচ্চ শক্তি লক্ষণ সাদৃশ্যে প্রয়োগে সুন্দর কাজ হয়।
নাক্স ভমিকার অন্য নামঃ
ঔষধটির আরো কিছু পরিচিত নাম আছে যেমন- Kuchela, Poison Nut, Nux Vom, Nuez Vomica, Noix Vomique, Kupilu, Strychnos Seed, Shudha Kupilu, Strychnos Vishamushti, Strychni Semen, Quaker Buttons, Vomiquier, Brechnusssamen ইত্যাদি।
নাক্স ভমিকার হোমিওপ্যাথিক ব্যবহারঃ
এই হোমিওপ্যাথিক ঔষধটি নানা ধরনের রোগের উপরে প্রয়োগ করা যায়। কিন্তু অবশ্যই স্মরণে রাখতে হবে যেন লক্ষণ সাদৃশ্য বজায় থাকে। রোগ এবং রোগীর লক্ষণ সাদৃশ্য এর সাথে মিল না রেখে শুধু প্যাথলজিক্যাল লক্ষণের উপর নজর রেখে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ প্রয়োগ করলে তেমন কোন ফল পাওয়া যায় না। যারা সাধারণত বাইরের খাবার খাবার বেশি খেয়ে থাকে, মাদকদ্রব্য সেবন ও পেটেন্ট ঔষধ এর অধিক ব্যবহার করে এছাড়াও কাজের জন্য রাত জাগতে হয় তাদের জন্য ঔষধটি অধিক উপযোগী।
পাকস্থলী, লিভার এবং পেটব্যথাঃ
নানাবিধ পেটের রোগ, হজমের সমস্যা, নানাবিধ লিভারের রোগ ইত্যাদি তে নাক্স ভমিকা ঔষধটি বহুল ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বিশেষত এই সকল রোগ সৃষ্টি হয় যদি অতিরিক্ত ভোজন, অলস জীবন যাপন, নেশা, মদ্যপান, ধূমপান, জর্দা-তামাকের অতিরিক্ত ব্যবহার, চা, কফি, অ্যালকোহল ইত্যাদি সেবনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া, অতিরিক্ত রাত জাগার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া, নানাবিধ ঔষধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া, এসব থেকে কোন রোগের সৃষ্টি হয়ে থাকে তবে নাক্স ভমিকা সেখানে উপযোগী।
তবে এ সকল ক্ষেত্রে অবশ্যই স্মরণে রাখতে হবে যে শক্তিকৃত নাক্স ভমিকা ঔষধটি লক্ষণ সাদৃশ্য ছাড়া শুধুমাত্র রোগের নাম ধরে গতানুগতিক ভাবে প্রয়োগ করলে কোন উপকার হবে না। ঔষধ টি প্রয়োগের পূর্বে অবশ্যই রোগীর এবং রোগের লক্ষণ সাদৃশ্য মিলিয়ে নিতে হবে। নাক্স ভামিকা অনেক ঔষধের প্রতিক্রিয়া রোধ করতে আমরা সচরাচর ব্যবহার করে থাকি।
তবে ওই একই শর্ত লক্ষণ সাদৃশ্য ব্যতিরেকে এটি প্রয়োগে আমরা সুফল পাবো না। আমরা অনেক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক এই সকল রোগের ক্ষেত্রে ধরা বাধা নিয়ম অনুযায়ী, গৎবাধা নিয়মে, রোগীর অন্য কোন লক্ষণ সাদৃশ্য না মিলিয়েই ঔষধটি প্রয়োগ করে থাকি। কিন্তু এটি ঠিক নয়। সুতরাং একজন চিকিৎসককে এই সকল বিষয়ে অবশ্যই সচেতন হতে হবে।
নাক্স ভমিকা ডোজঃ
নাক্স ভমিকা ঔষধটি শক্তিকৃত এবং স্থূল মাদার টিংচার এই দুটি ফর্মেই ব্যবহৃত হয়। সাধারণত ক্রণিক রোগাবস্থায় এবং জীবনী শক্তির সূক্ষ স্তর থেকে রোগ আরোগ্য করতে শক্তিকৃত ঔষধ ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ বিশেষ প্যাথলজিক্যাল ক্ষেত্র ব্যতীত আমরা
সর্বদাই শক্তিকৃত ঔষধ ব্যবহার করব। শক্তি কৃত ঔষধের ফর্মগুলো হলঃ
Nux Vomica 6,
Nux Vomica 30 or Nux Vomica 30c
Nux Vomica 200 or Nux Vomica 200c
Nux Vomica 1m
Etc.
(এখানে ‘c’ বলতে ঔষধের শততমিক শক্তিকে বোঝায়। হোমিওপ্যাথিক শক্তিকৃত ঔষধ দশমিক, শততমিক এবং 50 সহস্রতমিক এই তিনটি প্রক্রিয়ায় প্রস্তুত করা হয়)
তবে বিশেষ প্যাথলজিক্যাল ক্ষেত্রে আশু রোগ জনিত পরিস্থিতি উপশম এর জন্য কখনো কখনো নাক্স ভমিকা ঔষধটি মাদার টিংচার ফর্মে প্রয়োগের প্রয়োজন হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে ঔষধ এর মূল আরোক জলের সাথে মিশিয়ে একটি নির্দিষ্ট পরিমানে খেতে হয়। শক্তিকৃত অথবা মাদার টিংচার যে কোন ঔষধই সেবনের পূর্বে অবশ্যই একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শে বা নির্দেশক্রমে তা গ্রহণ করতে হবে।
নাক্স ভমিকা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াঃ
অবশ্যই হোমিওপ্যাথিক ঔষধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে। যে কোন ঔষধ ভুল ভাবে নির্বাচিত হলে এবং সেই ঔষধ ভুল ফর্মে ও ডোজে অধিক দিন সেবন করলে নিশ্চয়ই ক্ষতি হবে। বিশেষ করে নাক্স ভম এর মাদার টিংচার নিয়মিতভাবে অধিক দিন সেবন করলে মেরুদন্ড এবং নার্ভাস সিস্টেম এর ক্ষতি হতে পারে। এবং নাক্স ভম এর শক্তিকৃত ঔষধ ও নির্দিষ্ট ডোজে সেবন করতে হয়। নতুবা এই ঔষধ ক্রমাগত অধিক দিন সেবন করতে থাকলে ঔষধজ রোগ লক্ষণ দেখা দেবে।
নাক্স ভমিকা হোমিওপ্যাথিক ঔষধটির মাদার টিংচার এর ভেতর অ্যালকালয়েড হিসেবে Strychnos এবং Brucine উপস্থিত থাকে যা স্নায়ু কেন্দ্রের উপর প্রবল ক্রিয়া করে। এই অ্যালকালয়েড (16th century) ১৬ শতাব্দীতে জার্মানে ইঁদুর মারার বিষ হিসেবে ব্যবহৃত হত। কবুতর, খরগোশ ইত্যাদির উৎপাত থেকে বাচতে, সজারু এবং অন্যান্য ক্ষতিকর মাংসাশী প্রাণী নিয়ন্ত্রণ করতেও Strychnos মিশ্রিত টোপ ব্যবহার করা হত।
এর প্রভাব প্রাথমিকভাবে (Spinal Cord) স্পাইনাল কর্ড এর উপরে অনুভূত হয়। এটি মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া হলে কোন মানুষ অজ্ঞান পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। এমনকি খিঁচুনি দেখা দিতে পারে।
নাক্স ভমিকা বা কচিলা বীজের ভেতর থেকে যে স্ট্রাইকাইন পাওয়া যায় তার পরিমাণ 1.5% এর মত। এমনকি এর শুকিয়ে যাওয়া ফুলেও প্রায় 1.0% এর মত স্ট্রাইকাইন থাকে। পরীক্ষা করে দেখা গেছে নাক্স ভমিকা গাছের বাকলে ব্রুসিন এবং আরো অন্যান্য কিছু বিষাক্ত যৌগ পাওয়া যায়। ব্রুসিন এর চেয়ে স্ট্রাইকাইন বেশি বিষাক্ত। ব্রুসিন এর একটি ভালো উৎস হিসাবে ব্যবহৃত হয় এই বৃক্ষ। এই সকল বিষাক্ত যৌগ মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে ব্যবহৃত হলে তা শরীরে নানাবিধ ক্ষতি করতে পারে।
নাক্স ভমিকার হ্রাসবৃদ্ধিঃ
খুব সকালবেলায় বা প্রত্যুষে, আহারের অনতিবিলম্বে, ঘুমে বাধা পেলে ইত্যাদি কারণে এর রোগ লক্ষণ বেড়ে যায়।
পরিশেষে বলা যায় নাক্স ভমিকা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা ক্ষেত্রে এমনই একটি নিত্য ব্যবহার্য ঔষধ যেমন তরকারির সাথে লবণ। এটির বহুমুখী ব্যবহারিক লক্ষণ এবং উপকারিতা দেখে একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক হিসেবে আমি সত্যিই মুগ্ধ। ঔষধটিকে আত্মস্থ করার জন্য আমাদের মেটেরিয়া মেডিকা বারবার অধ্যায়ন করা প্রয়োজন।
আরো পড়ুনঃ ধুমপান ছাড়ার উপায়ঃ সর্বোচ্চ ৩ সপ্তাহে ধুমপান ছাড়ুন