প্রাথমিক আলোচনাঃ পান পাতার উপকারিতার বিষয়ে আলোচনা করবো আজকের আর্টিকেলে। পান পাতার যথেচ্ছ ব্যবহারে শারীরিক নানাবিধ অপকারিতা দেখা দিতে পারে। তবে পান পাতার পরিমিত ব্যবহার দ্বারা কিভাবে আমরা পান পাতার উপকারীতা যথার্থ রুপে পেতে পারি চলুন সেই আলোচনাতে প্রবেশ করা যাক।
পান পাতার পরিচয়ঃ
পান পাতার একটি নাম হল ‘তাম্বুল’। Piperaceae পরিবারের সদস্য এই পান গাছ গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে জন্মে থাকে। লতা জাতীয় এই গাছটি পরগাছার মত অন্য কোন বাহককে আশ্রয় করে বেড়ে ওঠে। পান গাছের বোটানিক্যাল নাম হল ‘Piper betle Linn’. পান পাতার দ্বিপদী নাম বা Scientific name হল ‘Piper betle’. দ্বিপদ নামকরণকে ‘বাইনারি নাম’ বা ‘ল্যাটিন নাম’ নামেও অভিহিত করা হয়।
বাংলা এবং হিন্দি উভয় ভাষাতেই এই পান পাতা কে ‘পান’ নামে ডাকা হয়। সংস্কৃত ভাষায় এটির নাম ‘তাম্বুলা’ ও ‘নাগাভাল্লী’। ফরাসি ভাষায় এটির নাম ‘তানবুল’। ‘Betel leaves‘ হলো এটার ইংরেজি নাম।
পান পাতার জগৎঃ Plantae, বর্গঃ Piperales, পরিবারঃ Piperaceae, গণঃ Piper, প্রজাতিঃ P. betle.
কোন অঞ্চলের মানুষ পান পাতা খায়?
দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো, এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মানুষেরাই সাধারণত পান খেয়ে থাকে। দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের মানুষজনই অধিক পরিমাণে পান পাতা খেয়ে থাকেন।
পান পাতার উপকারিতাঃ
পান পাতার উপকারিতা ও অপকারিতা দুটিই আছে। পান পাতার সুগন্ধি ও স্বাদের জন্য দীর্ঘদিন যাবত আমাদের সংস্কৃতিতে এর ব্যবহার রয়েছে। মুখশুদ্ধির জন্যও অনেকে পান খেয়ে থাকেন। পান খাওয়ার উপকারিতা গুলো কি কি চলুন দেখে নেওয়া যাক।
হজম শক্তি বৃদ্ধিঃ পানের ভেতর ক্ষারত্বের মাত্রা বেশি থাকায় এটি এসিডিটির উপর কাজ করে। ফলে এটি আমাদের হজমকারী এনজাইম এর উৎপাদন বৃদ্ধি করার ফলে আমাদের হজম শক্তি বৃদ্ধি হয়। পান পাতা ক্ষিদে বাড়িয়ে থাকে। কিছু ক্ষেত্রে এটি কোষ্ঠকাঠিন্য রোগের ক্ষেত্রেও উপকার করে থাকে।
মুখের স্বাস্থ্য রক্ষাঃ পান পাতাতে এন্টি মাইক্রোবিয়াল ক্ষমতা থাকায় এটি আমাদের মুখের ভেতরের বিভিন্ন ছত্রাক এর সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং ছত্রাক দমন করে থাকে। ফলে আমাদের মুখ গহ্বরের স্বাস্থ্য ভালো থাকে।
ক্ষত নিরাময়ঃ পান পাতাতে এন্টি ব্যাকটেরিয়াল এবং ফাঙ্গাল ইনফেকশন রোধী গুণাবলী থাকার কারণে তা বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া এবং ফাংগাল এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং আমাদের শরীরের যে কোন ক্ষত বা ঘা কে আরোগ্য করতে সাহায্য করে থাকে। এমনকি কোথাও কেটে গেলে বা থেতলে গিয়া আহত হলে কাঁচা পান পাতা পিষে লাগালে দ্রুত রক্ত বন্ধ হয় এবং তাড়াতাড়ি ক্ষত আরোগ্য হয়। অনেক সময় যারা বারবার পানিতে হাত বা পা ভিজিয়ে কাজ করে থাকে তাদের পায়ের আঙ্গুলের গলিতে বাঁ হাতের আঙ্গুলের গলিতে ক্ষত তৈরি হয়। এই ক্ষততে পান পাতার রস লাগালে বা পান পাতা পিষে লাগালে দ্রুত ক্ষত উপশম হয়।
প্রদাহ কমায়ঃ পান পাতাতে অ্যান্টি ইনফ্লামেটরি গুণাবলী থাকায় তা শরীরের বিভিন্ন রকম প্রদাহকে কম করতে পারে। বিভিন্ন প্রকারে রিউমেটিজম এবং আর্থ্রাইটিস এর রোগীদের প্রদাহ কিছুটা হলেও কমাতে পারে এটি। কিছু ক্ষেত্রে হাঁপানির উপরেও কাজ করে থাকে পান পাতা।
বিষাক্ততা প্রশমনঃ খাবারের সঙ্গে যদি কখনো কিছু পরিমানে বিষাক্ত কিছু সেবন করা হয়ে যায় সেই ক্ষেত্রে সামান্য একটু পান পাতা বা পান পাতার রস সেবন করলে সেই বিষাক্ততা কেটে যেতে পারে। যেকোনো প্রকারের অ্যাসিডিক বিষকেও এটি প্রশমিত করে থাকে। পুরোপুরি না হলেও কিছু মাত্রায় এই বিষের প্রভাবকে কমাতে পারে পান পাতা। এই কারণেই খাবার খাওয়ার শেষে পান খাওয়ার বিষয়টি বহুদিন যাবত আমাদের সংস্কৃতিতে প্রচলিত রয়েছে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণঃ পান পাতাতে এন্টি-হাইপারগ্লাইসেমিক যৌগ থাকায় রক্তে গ্লুকোজ বা শর্করার ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণের উপরেও কিছুটা কাজ করে থাকে। ডায়াবেটিস-২ তে আক্রান্ত রোগীরা প্রতিদিন সকাল বেলায় খালি পেটে কাঁচা পান খেয়ে উপকার পান কিনা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।
পান পাতার বোটার ক্ষমতাঃ
এটি পান পাতার অদ্ভুত গুণ যে যদি একটি পানপাতা কে তার বোটাসহ স্থির জলের উপর ভাসিয়ে দেয়া হয় এটি আস্তে আস্তে উত্তরমুখী হয়ে যাবে। অর্থাৎ পানের বোটাটি উত্তর মুখের দিকে চলে আসবে। স্থির জলে একটি বোটাসহ পান পাতা ভাসিয়ে দিন দেখবেন ধীরে ধীরে এর বোটাটি ঘুরে উত্তর দিকে চলে গেছে। বিষয়টি মজার, যদি কখনো কোনো অরণ্যের মাঝে দিক খুঁজে না পাওয়া যায় আর তখন যদি কাছে কোন পানপাতা থাকে তবে তা কোন স্থির জলে ভাসিয়ে দিলে তা উত্তর দিককে দেখিয়ে দেবে! আর উত্তর দিক পেলে অন্যান্য দিক গুলোও খুঁজে পাওয়া যাবে তখন!
সর্বোচ্চ সূর্যের আলো শোষণকারী পাতাঃ
পান পাতার একটি অদ্ভুত গুণ রয়েছে। এটি সূর্যের আলো সব থেকে বেশি পরিমাণে শোষণ করতে পারে। অন্য আর কোন গাছের পাতাই পান পাতার মত এতটা সূর্যের আলো শোষণ করতে পারে না। পান পাতার বোটাটাই সবথেকে বেশি সংবেদনশীল হয় আলোর প্রতি। এই কারণে পানের বোঁটা খেলে তা আমাদের স্নায়ুতন্ত্র কে অধিক উন্নত করে তোলে এবং আমাদের বোধ ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলে। এইজন্যই এটি সরাসরি সূর্যের আলোতে বাড়তে পারে না। সাধারণত ছায়ার ভেতরই এই গাছ বেড়ে ওঠে। এই কারণে সাধারণত বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যায় পানের বরজ গুলোতে শুকনো কলার পাতা, শুকনো সুপারির পাতা বা এ জাতীয় কিছু দ্বারা চারিপাশে ঢেকে ছায়া দেওয়া হয়েছে।
পান পাতা ভাগ করার নিয়মঃ
অনেক সময় আমাদের একটি পান পাতা কে দু ভাগে ভাগ করে খাওয়ার প্রয়োজন হয়। সেই ক্ষেত্রে যেন কখনোই লম্বালম্বি পানের মধ্যশিরা বরাবর অর্থাৎ পানির মেরুদন্ড বরাবর চেরা না হয়।
কেননা পানের এই মধ্যশিরাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পান পাতাটা যদি দু ভাগে ভাগ করার প্রয়োজন হয় তবে উলম্ব ভাবে নয় বরং আড়া-আড়ি ভাবে তা কেটে নেয়া উচিত। একটি পান পাতার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো মধ্যশিরা। তাই যখন ভাগ করে দুজন একটি পান খায় তখন প্রত্যেকেই যেন এই মধ্যশিরার কিছুটা অংশ পায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
পান পাতার অপকারিতাঃ
বিষ কাকে বলে? এই প্রশ্নের উত্তর হল প্রয়োজনের অতিরিক্ত সবকিছুই বিষ! পান পাতার উপকারিতা রয়েছে অনেক তবে তা অতিরিক্ত পরিমাণে, অনিয়মিতভাবে এবং নেশা সৃষ্টি হয় এরকম ভাবে খেলে উপকারের পরিবর্তে বরং ক্ষতিই হয়ে থাকে। এছাড়াও পানের সঙ্গে অধিক মসলা, জর্দা, তামাক, বিভিন্ন সুগন্ধি এসব মিশিয়ে খেলেও তা নানাবিধ রোগের সৃষ্টি করে থাকে। তাই পান পাতা বা পানের বোঁটা খেলেও তা নিয়মিত খাওয়া উচিত নয়। মাঝেমধ্যে খাওয়া যেতে পারে। খাবারের পর পান খেলেও তা অল্প পরিমানে খাওয়া উচিত। এবং সুপারি বা এই জাতীয় অন্য কিছু পানের সঙ্গে ব্যবহার করার পরিবর্তে শুধুমাত্র পান পাতা সেবন করলেই পান পাতার উপকারিতাটা সম্পূর্ণভাবে পাওয়া যেতে পারে। নিতান্তই কখন সখনো একটু মৌরি পানের সাথে খেলে মন্দ হয় না। তবে বারবার এভাবে মৌরি দিয়ে পান খেতে খেতে আবার তা নেশার অভ্যাসে পরিণত না হয়ে যায় এ ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে।
ক্ষত্রিয় পরম্পরায় পান পাতার ব্যবহারঃ
ক্ষত্রিয়দের ক্ষেত্রে একটি পরম্পরা আছে যদি কোন ব্যক্তি পানপাতা হাতে তুলে নেন তার মানে তিনি কোন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে আগ্রহী বা সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন। এই পরম্পরাটি অনেক পুরাতন। পান হাতে তোলা মানেই সেই ব্যক্তি কোন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ স্বইচ্ছায় করতে ইচ্ছুক এমন অভিব্যক্তি দেখায়।
পান পাতার উপকারিতা এবং অপকারিতা সম্বন্ধে এতক্ষণ আমরা জানলাম। এখন আমরা পান পাতা খাওয়ার সম্বন্ধে আরো কিছু প্রশ্ন এবং তার উত্তর সম্বন্ধে জানব যেগুলো প্রায়ই মানুষ জিজ্ঞাসা করে থাকেন। চলুন তবে প্রশ্নোত্তর পর্বে।
পান খেলে কি গ্যাস হয়?
পরিমিত মাত্রায় পান পাতা সেবনের নানাবিধ উপকারী দিক রয়েছে। পূর্বেই আমরা জেনেছি পান পাতা সেবনের ফলে আমাদের হজম শক্তির উন্নতি হয়, ডাইজেস্টিভ সিস্টেম সুস্থ থাকে এবং আমাদের আহারে রুচি বৃদ্ধি পায়। আরো নানারকম শারীরিক উপকারিতা পান পাতা সেবন করলে আমরা পেয়ে থাকি। তবে অতিরিক্ত মাত্রায় এবং অধিক পরিমাণে পান খেলে এবং তার সাথে সাথে জর্দা, তামাক লবঙ্গ, এলাচ বা এই জাতীয় অন্য কোন পদার্থ ব্যবহার করলে সেটি থেকে অনেক সময় গ্যাসের সমস্যা হতে পারে। পান বা সুপারি এগুলোর গুণগতমান ভালো না হলেও অনেক সময় পেটে গ্যাসের সমস্যা হতে পারে।
এছাড়াও দেখা যায় কোন কোন ব্যক্তি কোন বিশেষ খাবারের প্রতি সংবেদনশীল হয়ে থাকে। অর্থাৎ ঐ সকল খাবার ওই ব্যক্তির শারীরিক নানা কষ্টকর উপসর্গ, এলার্জি ইত্যাদি প্রকাশ করতে সাহায্য করে। যদি পানের প্রতি কারো ওই প্রকারের সাংবেদনশীলতা থেকে থাকে তবে সেই ক্ষেত্রে তার পান খাওয়ার কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে কিনা সেই দিকে নজর রাখবেন। তবে সচেতনভাবে পরিমিত মাত্রায় পান পাতা সেবনে কোন প্রকার ক্ষতি হয় না। এবং পানের সাথে সুপারি বা এই জাতীয় অন্য কোন খাবার ব্যবহার না করে শুধু পান পাতা খাওয়াই ভালো। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুপারির পরিবর্তে মৌরি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে তা ব্যবহার করা গেলেও অল্প পরিমাণে ব্যবহার করতে হবে।
চুলের জন্য পান পাতার উপকারিতা কি?
অ্যান্টিসেপটিক গুণ থাকায় এই পান পাতা চুলের উপকারেও কাজে আসে। এটি চুলের গোড়ায় কোনরকম জীবনুর সংক্রমণ থাকলে তা প্রতিরোধ করে। চুল পড়া কমায় এবং চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। চুলকে মজবুত ও ঘন কালো করে এবং চুলের গোড়ায় রক্ত সঞ্চালন বাড়িয়ে দ্রুত চুলকে বৃদ্ধি করে থাকে। এবং চুলের স্বাস্থ্য ভালো থাকার কারণে অনেক ক্ষেত্রে চুল পাকাও রোধ হয়।
পান পাতার সেবনে মানুষের অনুভব শক্তি বাড়ে এবং তার ফলে কর্মক্ষমতা ভিন্ন স্তরে পৌঁছে থাকে। কারণ পান আমাদের স্নায়ুতন্ত্রকে উদ্দীপনা জাগায়। অর্থাৎ পান খেলে স্নায়ু গুলো কিছুটা পরিমাণে হলেও উত্তেজিত হয়ে থাকে। আমাদের ঘ্রাণ শক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই এর প্রভাব পড়ে। দেখা গেছে পরিমিত মাত্রায় পান পাতা সেবনে আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ই অতিরিক্ত শক্তি লাভ করে থাকে।
মানুষের উপলব্ধি ও কর্মক্ষমতা ভিন্ন স্তরে পৌঁছে দিতে পারে এই পান পাতা। তবে এই সকল ক্ষেত্রে অবশ্যই পানের বোটাটি লম্বা থাকতে হবে। অন্তত এক ইঞ্চির মতো পানের বোটাটি লম্বা থাকলে খুব ভালো হয়। এই বোটাটিকে ছিড়ে ফেলে দিয়ে শুধু পান পাতাটি খাওয়া হলে সে ক্ষেত্রে এই সুফল খুব বেশী পাওয়া যাবে না।
শেষ কথাঃ পান পাতার উপকারিতা আলোচনা করার সাথে সাথে আমরা এই পাতার বিষয়ে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করেছি। পান পাতার সম্বন্ধে বিচিত্র এই অভিজ্ঞতা আমাদের নানা সময় কাজে আসতে পারে।
আরো পড়ুনঃ কাঁচা হলুদ ও নিম পাতার উপকারিতা
এই লেখাটি আপনার উপকারে এসেছে কি? আরো নতুন লেখা তৈরির জন্য আর্থিকভাবে অবদান রাখতে পারেন। যেকোন পরিমাণ আর্থিক কন্ট্রিবিউশন করতে নীচের ডোনেট বাটন ব্যাবহার করুন।
[custom_donation]