শুরুর কথাঃ আজকের আলোচনাতে আমরা মাইগ্রেনের বিষয়ে জানব। মাইগ্রেন জনিত মাথায় যন্ত্রণার কারণ সহ আরো যে সকল বিষয়ে আমি এই প্রবন্ধে আলোচনা করব তা হল মাইগ্রেন শব্দের উৎপত্তি, মাইগ্রেনের লক্ষণ ও রোগ উপসর্গ, মাইগ্রেন রোগের প্যাথলজিক্যাল ইনভেস্টিগেশন, মাইগ্রেন এর ট্রিটমেন্ট বিশেষত মাইগ্রেন এর হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা থাকবে। এছাড়াও মাইগ্রেন জনিত যে মাথা ব্যাথা হয়ে থাকে এই মাথা ব্যাথার উপশম এবং চিরতরে মাইগ্রেন থেকে মুক্তির উপায় জানতে এই লেখাটি সম্পূর্ণ পড়ুন।
মাইগ্রেন কি?
মাইগ্রেন শব্দের উৎপত্তিঃ
মাইগ্রেন শব্দটি গ্রিক হেমিক্রানিয়া(Hemikrania) শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ মাথার একদিকে ব্যথা। হেমি(Hemi) অর্থ Half বা অর্ধেক এবং ক্রেনিয়া(Kranion) অর্থ Skull বা খুলি। অর্থাৎ মাথার অর্ধেক অংশে ব্যথা হলে তাকে মাইগ্রেন বলে। খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীতে প্রাচীন গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটিস প্রথম মাইগ্রেনের বর্ণনা দেন। ১৭ তম শতাব্দীতে এটি ইংরেজিতে(Megrim) মেগ্রিম নামে প্রবেশ করে। ১৯ শতাব্দীতে এটি “Migraine” নামে প্রচলিত হয়।
মাইগ্রেনের কারণঃ
মাইগ্রেন কেন হয় বা মাইগ্রেনের ব্যাথার জন্য দায়ী এরূপ স্থুল কোন কারণ এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। তবে হোমিওপ্যাথিক দর্শন অনুযায়ী রোগটির পেছনে সাইকোটিক মায়াজম এর ভূমিকা মুখ্য। আমার ব্যক্তিগত চিকিৎসা জীবনে এন্টিসাইকোটিক চিকিৎসা দ্বারা মাইগ্রেন-রোগটি আরোগ্য হতে দেখেছি বহুবার। অর্থাৎ মাইগ্রেনের ব্যথার কারণ হিসেবে মায়াজমেটিক কারণ এখানে প্রধান। আর গৌণ ও উত্তেজক কারণ হিসেবে আছে সূর্যের তাপ, মানসিক চাপ, অধিক পরিশ্রম, মানসিক দুশ্চিন্তা, ঘুমের অভ্যাসের পরিবর্তন, ইত্যাদি। এছাড়াও কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে এর সকল উত্তেজক কোন কারণ ছাড়াই নিয়মিত একটা সময় পরপর এরকম মাইগ্রেনের বেদনা হয়ে থাকে।
রোগের লক্ষণ ও উপসর্গঃ
সাধারণত মাইগ্রেনের মাথা ব্যথা দিন অথবা রাত্রে যেকোনো সময়ে হতে পারে। অনেকের আবার সূর্যাবর্ত মাথাব্যথা অর্থাৎ বেলা বাড়ার সাথে সাথে মাথা ব্যথা ক্রমাগত বাড়তে থাকে এবং মধ্যাহ্নের পর বেলা পড়ার সাথে সাথে মাথা ব্যথা ও ক্রমাগত কমতে থাকে। মাইগ্রেনের লক্ষণ হিসেবে সাধারণত যে সকল রোগ উপসর্গ বা শারীরিক অসুস্থতা দেখা যায় য় তা হলঃ
১) মাথার কোন এক পার্শে অথবা কখনো কখনো মাথার উভয় পাশে তীব্র মাথা ব্যথা হয়। একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর প্রায়ই এরকম হয়ে থাকে।
২) বমি বমি ভাব বা বমি হয়ে থাকে মাথা ব্যাথার সাথে সাথে।
৩) আলো, শব্দ ও গন্ধের প্রতি অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা দেখা দিতে পারে। অর্থাৎ অসুস্থতার এই সময়ে এই সকল পরিবেশ এর কাছাকাছি আসলে রোগ কষ্ট আরো বেড়ে যায়।
৪) চোখের দৃষ্টি ঝাপসা ঘোলা ঘোলা হতে পারে। প্রচন্ড ক্লান্তি ও দুর্বলতা দেখা দিতে পারে।
৫) মাথা ব্যথা কয়েক ঘন্টা থেকে সারাদিন পর্যন্ত থাকতে পারে। কারো কারো ক্ষেত্রে মাইগ্রেনের ব্যথা একবার শুরু হলে তিন থেকে চার দিন পর্যন্ত থাকতে দেখা যায়।
৬) ঘুমের সমস্যা দেখা দেয়। মন মেজাজ এর পরিবর্তন হতে পারে এই সময়।
প্যাথলজিক্যাল ইনভাস্টিগেশনঃ
মাইগ্রেন রোগটি নির্ণয়ের জন্য নির্দিষ্ট কোন প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা নেই। তবে রোগের সম্ভাব্য কারণগুলি মূল্যায়ন করতে এবং মাইগ্রেনের ধরন নির্ধারণ করতে কিছু ল্যাবরেটরি পরীক্ষা করা যেতে পারে। যেমন-
CBC, থাইরয়েড ফাংশন টেস্ট, সিটি স্ক্যান, এমআরআই ইত্যাদি। এছাড়াও রোগীর অতিত ইতিহাস, রোগের সাধারণ লক্ষণ, রোগের বিবরণ ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করে একজন চিকিৎসক ক্লিনিক্যালি রোগটি নির্ণয় করতে পারেন।
মাইগ্রেনের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাঃ
মাইগ্রেন সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা অনুযায়ী মাইগ্রেনের ঔষধ সম্বন্ধে এখন আলোচনা করছি।
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা সাধারণত লক্ষণ ভিত্তিক। অর্থাৎ যেকোনো রোগেই রোগের সাধারণ অর্থাৎ যেকোনো রোগেই রোগীর শারীরিক-মানসিক এবং আঙ্গিক লক্ষণ সংগ্রহ করে, রোগের পেছনের কারণ জেনে, সামগ্রিকভাবে রোগীকে মূল্যায়ন করে মাইগ্রেন ট্রিটমেন্ট করতে হয়।
মাইগ্রেনের চিকিৎসায় ব্যবহৃত প্রধান প্রধান হোমিওপ্যাথিক ঔষধ গুলো হলো বেলেডোনা, স্পাইজেলিয়া, স্যাঙ্গুনেরিয়া,থুজা অক্সিডেন্টালিস, নাক্স ভমিকা, গ্লোনইন, সালফার, ল্যাকেসিস, পালসেটিলা, সিপিয়া, লাইকোপোডিয়াম ইত্যাদি। লক্ষণ থাকলে হোমিওপ্যাথিক মেটেরিয়া মেডিকা থেকে আরো যে কোন ঔষধই মাইগ্রেনের ঔষধ হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে। গভীর থেকে সম্মুখে আরোগ্য করতে হলে উচ্চশক্তিতে ঔষধের প্রয়োগ করতে হবে। শরীরের গভীর থেকে অর্থাৎ জীবনী শক্তির স্তর থেকে মাইগ্রেনের ব্যথা আরোগ্য করতে হোমিওপ্যাথিক ক্লাসিক্যাল মাইগ্রেন ট্রিটমেন্ট করতে হবে। এই বিষয়ে একজন অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
শেষ কথাঃ মাইগ্রেন এর মাথাব্যথা তীব্র আকার ধারণ করলে তা আমাদের দৈনন্দিন জীবনাচরণের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এই রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করতে অর্থাৎ মাইগ্রেনের মাথাব্যথা কমানোর উপায় হিসেবে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা একটি আদর্শ বিকল্প হতে পারে।
নিজ স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন থাকুন, সাবধান থাকুন, স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন মেনে চলুন।
সতর্কতাঃ আর্টিকেলটি শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছে। রোগজনিত যেকোনো প্রয়োজনে একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন। নিজে নিজে কখনোই ঔষধ কিনে সেবন করবেন না। কেননা ঔষধের শক্তি, মাত্রা এবং ব্যবহার বিধি সম্বন্ধে একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকই কার্যকরী পরামর্শ দিতে পারেন।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাঃ আমি আমার ব্যক্তিগত চিকিৎসা জীবনে বেশ কিছু মাইগ্রেনের রোগীর চিকিৎসা করেছি। এর ভেতর বেশ কয়েকটি কেস ছিল দুরারোগ্য প্রকৃতির। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায়, হোমিওপ্যাথি ঔষধের ক্রিয়ায় বেশ কিছু রোগী দীর্ঘদিন যাবত ভুগতে থাকা এই দুরারোগ্য প্রকৃতির মাইগ্রেনের মাথাব্যাথা থেকে সেরে উঠে এখন সুস্থ্য, স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন। সেই সাকসেস কেসগুলোর ভেতর থেকে কয়েকটি শিক্ষামূলক ও গুরুত্বপূর্ণ কেস আমি পরবর্তীতে সময় ও সুযোগ পেলে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করার চেষ্টা করব।
আরো পড়ুনঃ ধুমপান ছাড়ার উপায়ঃ সর্বোচ্চ ৩ সপ্তাহে ধুমপান ছাড়ুন