ভূমিকাঃ আজকের এই আর্টিকেলে আমরা “রাসেল ভাইপার” বা “চন্দ্রবোড়া” বা “উলুবোড়া” সাপের বিষয়ে বিস্তারিত জানব। রাসেলস ভাইপারের বৈশিষ্ট্য, এর বাসস্থান, আচরণ, বিষক্রিয়ার ধরন, সাপে কাটার চিকিৎসা বিষয়ক তথ্য ও সচেতনতা, সংক্ষেপে অ্যান্টিভেনম এর বিস্তারিত এবং এই সম্পর্কেও আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করব। আশা করি লেখাটি সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিপূর্বক বিপদজনক এই সাপ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। তো চলুন মূল আলোচনায় প্রবেশ করা যাক।
রাসেলস ভাইপার সাপ কি?
আমাদের উপমহাদেশে সাধারণত চারটি প্রজাতির বিষধর সাপ দেখা যায়। যেমন কোবরা, কেউটে, শঙ্খচূড়, চন্দ্রবোড়া ইত্যাদি বিষধর সাপেদের ভেতর অন্যতম। এর ভেতর অন্যতম একটি সাপ রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া।
এটিকে উলুবোড়া নামেও ডাকা হয় এই অঞ্চলে। এই চন্দ্রবোড়া সাপটিরই একটি নাম হল রাসেলস ভাইপার(Russell’s Viper)। স্যার প্যাট্রিক রাসেল ১৭৯৬ সালে সাপ রাসেল ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া নামক এই সাপটিকে নিয়ে প্রথম লেখেন তার অ্যাকাউন্ট অফ ইন্ডিয়ান সাসপেন্টস, কালেক্টেড অন দা কোস্ট অফ করমান্ডেল বই এ।

পরবর্তীতে এই চন্দ্রবোড়া রাসেলস ভাইপার সাপটির বিষয়ে বর্ণনা করেন জর্জ শ এবং ফ্রেডেরিক পলিডর নোডার ১৭৯৭ সালে।
রাসেলস ভাইপার এর বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাসঃ
জগত/রাজ্যঃ অ্যানিম্যালিয়া(Animalia)
পর্বঃ কর্ডাটা
শ্রেণীঃ রেপটিলিয়া(Reptilia)
বর্গঃ স্কোয়াটা
উপ বর্গঃ সারপেন্টস(Serpents)
পরিবারঃ ভাইপারিডি(Viperidae)
গনঃ Daboia
প্রজাতিঃ Dr. Russelii
রাসেলস ভাইপার সাপের দ্বিপদী নাম বা বৈজ্ঞানিক নাম(scientific name) হল Daboia russelii.
রাসেলস ভাইপার সাপটির গঠনঃ
রাসেল ভাইপারের মাথাটি ত্রিকোনা আকৃতির হয়ে থাকে এবং মাথার তুলনায় ঘাটি আরো একটু বেশি সরু শরীরের মাঝামাঝি অংশটা বেশ মোটাসোটা এবং লেজের দিকটা ক্রমাগত শুরু হয়ে গেছে। রাসেলস ভাইপারের গায়ের রং হলদে বাদামী। খানিকটা শুকনো পাতা বা কাঠের রং এর মতো হাওয়াতে এটি আগাছা বা ঝোপঝাড়ের ভেতর নিজেকে সহজেই লুকিয়ে রাখতে পারে। সাপটির সারা গায়ে গাঢ় বাদামী রঙের বড় বড় গোল দাগ থাকে। গোলাকার এই দাগগুলোর সীমানা জুড়ে সাদা সাদা ছোট ছোট বিন্দু থাকে। পেটের অংশটি সাদা রঙের আঁশ রঙ যুক্ত। এর জিহ্বার রং সাধারণত কালো বর্ণের হয়ে থাকে।
এদের বিষ দাঁত প্রায় ১৫ থেকে ১৬ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। বৃহৎ বিষদাঁত যুক্ত সাপেদের ভেতর রাসেলস ভাইপারের অবস্থান দ্বিতীয়। অর্থাৎ চন্দ্রবোড়া সাপটির বিষদাঁত লম্বায় পৃথিবীতে দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ দাঁত। রাসেল ভাইপার একসঙ্গে ঘরে প্রায় ৩৫টির মতো করে বাচ্চা দিয়ে থাকে। এবং ভূমিষ্ঠ এই বাচ্চাদের গড়ে অর্ধেকেরও বেশি শিয়াল, প্যাঁচা, গুইসাপ, ঈগল, বনবিড়াল, খাটাস, মঙ্গু বা বেজি ইত্যাদিতে খেয়ে ফেলে। এছাড়াও প্রাকৃতিক কারণবশতও অনেক বাচ্চা মারা যায়।
রাসেলস ভাইপার সাপ কত বড় হয়?
রাসেলস ভাইপার সাধারণত দৈর্ঘ্য 166 সেন্টিমিটার বা ৬৫ ইঞ্চির মতো লম্বা হয়ে থাকে। এটির শরীরের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় 49 ইঞ্চির মত। লেজের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৭ ইঞ্চি। ঘের বা চওড়া ৬ ইঞ্চির মতো। মাথার প্রস্থ 2 ইঞ্চি। এবং মাথার দৈর্ঘ্য ২ ইঞ্চি। এশিয়া মহাদেশের মূল ভূখণ্ডে এই সাপগুলোর দৈর্ঘ্য কিছুটা বেশি দেখা যায় তবে দ্বীপ অঞ্চলগুলিতে যে সাপগুলো দেখা যায় সেগুলো কিছুটা ছোট আকৃতির হয়ে থাকে।
রাসেলস ভাইপার সাপ কোন দেশের?
চন্দ্রবোড়া সাপটি সাধারণত বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ ইত্যাদি এই অঞ্চল গুলোতেই বেশি দেখা যায়। ভারতের ভেতরে পাঞ্জাবে এটি তুলনামূলক অধিক পরিমাণে দেখা যায়। এছাড়াও পশ্চিম উপকূল দক্ষিণ ভারত কর্ণাটক রাজ্য এবং পশ্চিম উপকূলের পাহাড় বরাবর অঞ্চলে এটি যথেষ্ট পরিমাণে দেখা যায়। তবে এটি গঙ্গা উপত্যকা, উত্তরবঙ্গ এবং আসামে খুবই কম দেখা যায় বা বিরল।
রাসেল ভাইপার কামড়ালে কি হয়?
চন্দ্রবোড়া সাপ কামড়ালে কি হয় চলুন জেনে নেই। রাসেলস ভাইপার বিষধর সাপেদের তালিকায় পঞ্চম অবস্থানে তবে হিংস্রতা ও আক্রমণের দিক দিয়ে প্রথম স্থানে রয়েছে এটি। কাউকে কামড়ানোর জন্য মনস্থির করলে এরা ১ সেকেন্ডের ১৬ ভাগের এক ভাগ সময়ের ভেতরে সেই কাজ সম্পন্ন করে থাকে। রাসেলস ভাইপার কাউকে কামড়ালে সে তার সকল বিষ ঢেলে দেয়।
রাসেলস ভাইপার যথেষ্ট বিষাক্ত তবে এটির থেকে বেশি বিষাক্ত হল গোখরো বা কেউটে সাপের বিষ। গোখরা সাপ দংশন এর প্রায় ৮ ঘন্টা, কেউটে সাপের ক্ষেত্রে ১৮ ঘন্টা এবং চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার দংশনের প্রায় ৭২ ঘন্টা বা তিন দিন পরে পর্যন্ত সাধারণত রোগী বেঁচে থাকে। রাসেল ভাইপার এর ক্ষেত্রে Mortality Rate অনেক বেশি। তাই অত্যাল্প সময়ের ভেতর রোগীকে এন্টিভেনম প্রয়োগ করা গেলে সাধারণত রোগী বেঁচে যায়। তাই বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে যেভাবে আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে এটিতে অনর্থক ভীত হওয়ার প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন শুধু সচেতনতার।
মনে রাখতে হবে সাপে কাটা রোগীদের মৃত্যুর বেশিরভাগই ঘটে থাকে দেরি করে হাসপাতালে পৌঁছানোর কারণে। এক্ষেত্রে সময়টা খুব বড় ফ্যাক্টর। যত দ্রুত সময়ের ভেতর সম্ভব রোগীকে এন্টিভেনম প্রয়োগ করতে পারলে রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ততো অধিক। তাই কোন ব্যক্তিকে সাপে কাটলে বৈদ্য বা ওঝার কাছে গিয়ে সময় নষ্ট করা যাবে না। সরাসরি চলে যেতে হবে হাসপাতালে।
রাসেলস ভাইপার সাপের এন্টিভেনামঃ
বাংলাদেশের একমাত্র ঔষধ কোম্পানি Incepta Pharmaceuticals Ltd রাসেলস ভাইপার এর এন্টিভেনম তৈরি করে থাকে। এন্টিভেনামটির নাম হল POLYVALENT ANTIVENIM SERUM(PAS). যে যে সাপে কামড়ালে বিষের বিরুদ্ধে এই কার্যকারী তা হল Cobra, Krait, Russell’s Viper, Saw Scaled Viper. এই সাপ গুলোর ক্ষেত্রেই একমাত্র এই এন্টিভেনম কার্যকরী।
সাপের এন্টিভেনম ব্যবহারের ক্ষেত্রে Dr. K.S Narayan Reddy স্যার এর রচিত Forensic Medicine Toxiology বইটিতে লেখা আছেঃ
It is useful when given within four hours of bite. it is of less value if delayed for eight hours, and in of doubtful value twenty-four hours.
অর্থাৎ সাপে কামড়ানোর ৪ ঘণ্টার ভেতরে যদি এই এন্টিভেনম রোগীকে প্রয়োগ করা যায় তবে রোগী বেঁচে যাওয়ার হার সর্বোচ্চ। সাপে কামড়ানোর চার ঘন্টা অতিবাহিত হয়ে গেলে তবে ৮ ঘণ্টার পূর্বে যদি রোগীকে এন্টিভেনম প্রয়োগ করা যায় তবে সেক্ষেত্রেও রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা আছে তবে সেটি কিছুটা কম সম্ভাবনা যুক্ত। আর সাপে কামড়ানোর পর ন্যূনতম ২৪ ঘন্টা পার হয়ে গেলে সে ক্ষেত্রে এন্টিভেনম প্রয়োগ সত্ত্বেও রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অনেকটা কমে যায় এবং পরিস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এভাবে যত সময় পার হতে থাকে তত রোগীর উপর এন্টিভেনম এর ক্রিয়াক্ষমতা কমতে থাকে।
সাপে কামড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে হাসপাতালে পৌঁছে দিতে হবে। কোনভাবেই ওঝার কাছে গিয়ে অথবা ঝাড়ফুঁক করে সময় নষ্ট করা যাবে না।
এন্টিভেনম এর দাম কত?
এন্টিভেনাম এটি ভেনম এন্টিসেরাম, এন্টিভেনম ইমিউওনোগ্লোবিউলিন, এন্টিভেনিন ইত্যাদি নামেও পরিচিত। Incepta কর্তৃক তৈরিকৃত অ্যান্টিভেনম এর এক একটি Vial এর দাম ১০০০০ টাকা করে । তবে সরকারি হাসপাতালগুলোতে এই সেবাটি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে প্রদান করা হয়। এন্টিভেনম ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। বিষক্রিয়া দ্বারা শরীর যখন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে তখনই এটি সুপারিশ করা হয়। এনটিভেনাম গুলোর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া খুব বেশি হয়ে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে শ্বাসকষ্ট, এনাফিলাক্সিস, সিরাম সিকনেস এছাড়াও এলার্জিজনিত নানাবিধ শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
এন্টিভেনম তৈরির প্রক্রিয়াঃ
প্রাসঙ্গিক প্রাণী থেকে বিষ সংগ্রহ করে তা অত্যল্প পরিমাণে গৃহপালিত পশুতে ইনজেক্ট করলে ঐ প্রাণীর শরীরে যে এন্টিবডি তৈরি হয় তা সংগ্রহ করে পরিশুদ্ধ করে এই এন্টিভেনম গুলো তৈরি করা হয়।
কামড় দেয়া সাপটি বিষধর কিনা কিভাবে জানা যায়?
অনেক সময় কামড় দেওয়ার পর হয়তো দেখতে পাওয়া যায় না যে সাপে কামড়েছে সেটি কেমন বা কোন প্রজাতির সাপ! এসব ক্ষেত্রে 20 Minutes Blood Clotting Test দ্বারা জানা যায় যে সাপটি কামড় দিয়েছে সেটি বিষধর কিনা?
এক্ষেত্রে চিকিৎসক রোগীর শরীর থেকে কিছুটা রক্ত নিয়ে আধা ঘন্টা সময়ের মত বাইরে রেখে দেয়। সাধারণত রক্তে কোন বিষাক্ততা না থাকলে এই সময়ের মধ্যে ঐ রক্ত জমাট বেঁধে যাবে। কিন্তু বিষাক্ত সাপে কামড়ালে ৩০ মিনিট অতিবাহিত হওয়ার পরেও ঐ রক্ত জমাট বাঁধবেনা। কারণ বিষাক্ত সাপের বিষে হেমাটোটক্সিন নামে একটি উপাদান থাকে যেটি রক্তের ক্লটিং ফ্যাক্টর গুলোকে নষ্ট করে রক্তকে জমাট বাঁধতে বাধা দেয়। এই পর্যায়ে চিকিৎসক রোগীকে এন্টিভেনম প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।
সাপে কামড়ালে তাৎক্যেষণিক করণীয়ঃ
কোনো বিষধর সাপ কামড়ালে রোগীকে শান্ত ও স্থির রাখতে হবে। আক্রান্ত অঙ্গ বেশি নাড়াচাড়া করা যাবেনা। কেননা আক্রান্ত অঙ্গ বেশি নাড়াচাড়া করলে বিষক্রিয়া দ্রুত সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। আরেকটি বিষয় এই সময় রোগীর কোন মতেই দুশ্চিন্তা করতে দেওয়া যাবে না। তাকে নানাভাবে মনোবল দিতে হবে। কেননা দুশ্চিন্তা করলেও এই বিষ শরীরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে সহায়ক পরিবেশ পায়। এই সময়ে সাধারণত রোগী অনেক ভয় পেয়ে থাকে এবং সাইকোলজিক্যাল শক এর কারণে অনেক ক্ষেত্রে রোগী মারা যেতে পারে।
আবারও সচেতন করছি সাপে কাটা রোগীকে কখনোই ওঝার কাছে নেবেন না, ঝাড়ফুঁক করে সময় নষ্ট করবেন না, যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে হাসপাতালে পৌঁছে দিন। রোগী বেঁচে যাবে।
শেষ কথাঃ মনে রাখতে হবে রাসেলস ভাইপোর তার বিষাক্ততার জন্য ভয়ংকর ও ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এটি পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং তা পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। ছোট ছোট ক্ষতিকর স্তন্যপায়ী প্রাণী, ইদুর, বিভিন্ন ক্ষতিকর সরীসৃপ ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তবে এটির আক্রমণাত্মক আচরণ মানুষের জন্য বিপদজনক বলে এটি থেকে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচিত হলেও আমাদেরই পরিবেশের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হওয়ায় এদের প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মানবিক থাকতে হবে।
বিশেষ অনুরোধঃ পৃথিবীতে কোন সাপই তার সঙ্গে ঝামেলা তৈরি না করলে অনর্থক তেড়ে আসে কাউকে কামড়ায় না। বরঞ্চ তার সাথে কিছুটা ঝামেলা হলেও সে পালিয়ে বাঁচতে চায়।
বন্যপ্রাণীর অধিকার সংরক্ষণ আমাদের অর্থাৎ মানুষেরই কর্তব্য। তাই অনর্থক ভীত সন্ত্রস্ত হওয়া বা আতঙ্কিত হওয়া অথবা গুজবে কান দেওয়া ইত্যাদি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অন্যায় ভাবে কোন প্রাণীকে হত্যা করা উচিত নয়। তাদেরও বাঁচার অধিকার আছে আমাদের এই ভূমিতে। তাই আমাদের তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ও মানবিক হতে হবে। খুব প্রয়োজন না হলে এই সাপ কে হত্যা করবেন না। এই বিষয়ে সচেতন ও মানবিক থাকতে হবে।