প্রথম কথাঃ আজকের আলোচনাতে শরীরে ঘা এর ব্যবস্থাপনা, ঘা এর কারণ, শরীরে ঘা হলে করণীয়, ঘা প্রতিরোধের উপায়, ঘায়ের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ইত্যাদি সহ আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। চলুন তবে মূল আলোচনাতে যাওয়া যাক।
শরীরে ঘা কি?
কোন সংক্রমণ, পুড়ে যাওয়া, আঘাত বা অন্য যেকোনো কারণে আমাদের চর্ম, কোষ বা কলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে শরীরে ঘা তৈরি হয়। এটি সচরাচর খুব সাধারণ প্রকৃতির সমস্যা হলেও কখনো কখনো তা কোন গুরুতর রোগের প্রাথমিক উপসর্গ হতে পারে। যেমন অনেক সময় ডায়াবেটিস রোগীদের হাত পায়ের তলে ঘা প্রকাশ পেতে দেখা যায়।
শরীরে ঘা এর কারণঃ
নানাবিধ কারণ থেকে শরীরে ঘা হতে পারে। তার মধ্যে বিশেষ কিছু কারণ হলোঃ
আঘাত পাওয়াঃ যে কোন প্রকার আঘাত বা ইনজুরি, সুচ, কাটা, আলপিন ইত্যাদি ফুটে গেলে সেখানে সংক্রমণ বশত কখনো কখনো ঘা তৈরি হতে পারে।
ক্রনিক রোগঃ টাইপ ২ ডায়াবেটিস, রক্ত পরিবহনজনিত অস্বাভাবিকতা বা এজাতীয় কোন ক্রনিক রোগের উপসর্গ হিসেবে শরীরে ঘা হতে পারে।
সংক্রমণঃ ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া বা ফাংগাল ইনফেকশন থেকে শরীরে ঘা বা পচনশীল ক্ষত হতে পারে।
পুড়ে যাওয়াঃ শরীরের কোথাও পুড়ে গেলে বা ক্ষতকারী কোন রাসায়নিক পদার্থ দ্বারা শরীরের কোথাও ঝলসে গেলে সেখানে ঘা তৈরি হতে পারে।
চর্মপীড়াঃ কিছু ক্ষেত্রে চর্মরোগ থেকে ঘায়ের সূচনা হয়ে থাকে এবং ধীরে ধীরে তা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।
শরীরে ঘা এর ব্যবস্থাপনাঃ
শরীরে ঘা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ সেবনের পাশাপাশি কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে হয়। শরীরে ঘা এর ব্যবস্থাপনা বা যত্নে করণীয় কাজগুলো হলোঃ
ঘা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখাঃ ঘায়ের স্থান যেন সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পরিষ্কার পানি দ্বারা বা ভেজা ন্যাকড়া বা তুলা ভিজিয়ে তার দ্বারা ঘায়ের অঞ্চল পরিষ্কার করে দিতে হবে। কোন ময়লা আবর্জনা সংস্পর্শ যেন না লাগে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
ক্ষতস্থান আবৃত উন্মুক্ত রাখাঃ পরিস্থিতি বিবেচনায় ক্ষত বা ঘা তৈরি হওয়ার প্রথম ৪৮ ঘন্টা পর্যন্ত ঢেকে রাখা যেতে পারে। কিন্তু এর পরে ওই স্থান উন্মুক্ত করে দেওয়াই উচিত। এবং তার সাথে সাথে চিকিৎসকের ব্যবস্থা করা মলম দিয়ে পরিচর্যা করা যেতে পারে। ঘা এর স্থান দীর্ঘ সময় ধরে আবৃত করে রাখলে আমাদের শরীর থেকে নিঃসৃত অনেক ক্ষতিকর পদার্থ যা ঘামের সাথে বেরিয়ে যায় তা আটকে পড়ে সংক্রমণ আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে পুড়ে যাওয়া ক্ষত বা এইরকম কিছু ক্ষেত্রে ক্ষতস্থান অধিক সময় ঢেকে রাখার প্রয়োজন হতে পারে। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
ঠান্ডা বা গরম সেঁক দেওয়াঃ শরীরে ঘা এর ব্যবস্থাপনা হিসাবে পরিস্থিতি বিবেচনা করে ক্ষতস্থান বা ঘা এর অঞ্চলে ঠান্ডা বা গরম সেঁক দেওয়া যেতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগী ঘায়ে প্রচন্ড ব্যথা বা জ্বালা অনুভব করতে পারে। সেসব ক্ষেত্রে ব্যথা বা জ্বালা কমানোর জন্য যদি রোগীর ভালো লাগে তবে ঠান্ডা সেঁক অথবা গরম সেঁক দিতে পারে। তবে সব সময় বিবেচনায় রাখতে হবে রোগী যেন তাতে আরাম পায়। অর্থাৎ যদি দেখা যায় রোগীর গরম সেঁক দিলে ভালো লাগছে শুধুমাত্র তাহলেই সেই রোগী গরম সেঁক দেবে।
সাধারণত আঘাতের প্রথম দিকে ঠান্ডা সেঁক দিতে পারলে ভালো হয়। সেই ক্ষেত্রে সরাসরি বরফ না দিয়ে কাপড়ে মুড়িয়ে বরফের সেঁক দেওয়া যেতে পারে। বরফের প্যাক বা ঠান্ডা পানির বোতল ব্যবহার করে দিতে পারে।
আঘাতের ৪৮ ঘন্টা পর থেকে গরম সেঁক দেওয়া যেতে পারে তার ফলে আঘাতের স্থানে রক্ত সঞ্চালন বাড়বে এবং মাংসপেশির জড়তা কমবে এবং প্রদাহ কম হবে।
পুষ্টিকর আহার গ্রহণঃ শরীরে যে কোন রোগে এবং ঘা বা ক্ষত এই জাতীয় রোগের ক্ষেত্রে জীবণী শক্তি যত সবল থাকে রোগ তত দ্রুত আরোগ্য হয়। আর জীবনী সক্তি সবল রাখতে পুষ্টিকর খাবারের বিকল্প নেই। ভিটামিন সি জাতীয় ফল যে কোন প্রকার ক্ষত দ্রুত আরোগ্য করতে সহায়তা করে কেননা এটি আমাদের শরীরে কোলাজেন তৈরিতে সাহায্য করে যা আমাদের ত্বককে মেরামত করতে এবং ঘা বা ক্ষতকে শুকাতে সাহায্য করে। এছাড়াও প্রোটিন, ভিটামিন ও জিংক সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
সচেতনতাঃ আমাদের সমাজে একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে টক জাতীয় খাবার খেলে ঘা সারে না। এটির কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। তাই সঠিক চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা থাকলে টক জাতীয় খাবার খাওয়া নিয়ে কোন বাধা নেই। ঔষধ সেবনের পাশাপাশি শরীরে ঘা এর ব্যবস্থাপনায় সতর্কভাবে মনযোগ দিতে হবে।
ঘা প্রতিরোধে করণীয়ঃ
ঘা বা এই জাতীয় রোগ প্রতিরোধে আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখতে হবে এবং জীবনী শক্তি যেন সবল থাকে সেই বিষয়ে নজর রাখতে হবে। তাই শরীর সুস্থ রাখতে পুষ্টিকর আহার গ্রহণ করতে হবে। ক্রনিক প্রকৃতির রোগ যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তের রোগ ইত্যাদির ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। ডায়াবেটিস থাকলে তা সর্বদা নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করতে হবে। সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে জীবন যাপন করতে হবে। যেকোনো প্রকার ঘা শরীরে দেখা দিলে অবহেলা না করে সেটিকে সচেতনভাবে নিতে হবে এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
ঘা এর হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাঃ
শরীরে ঘা তৈরি হওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে। এই কারণে বিভিন্ন ব্যক্তির ক্ষেত্রে পরিস্থিতি অনুযায়ী হোমিওপ্যাথিতে ভিন্ন ভিন্ন ঔষধ নির্বাচিত হবে। এবং রোগের কারণ, লক্ষণ, মডালিটি ইত্যাদি বিবেচনা করে ঔষধ নির্বাচিত হয়ে থাকে। শরীরে ঘায়ের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার জন্য নিচে কিছু সাধারন ওষুধের উল্লেখ করা হলোঃ
আর্নিকা মন্টেনাঃ যদি কোন আঘাত বা ইনজুরি থেকে ঘায়ের সূচনা হয়ে থাকে ব্যবহার করা চলে এবং রোগ আরোগ্য হয়।
লিডাম পলঃ ভাইয়ের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার লিডাম পল তখনই ব্যবহৃত হবে যদি ঘায়ের সূচনা কোন সুঁচ, আলপিন, পিন, কাটা এই জাতীয় সূঁচালো দ্রব্যের আঘাত থেকে তৈরি হয়ে থাকে। এছাড়াও লিডামের একটি মডালিটি সবসময় মনে রাখতে হবে যে সকল বেদনা বা যন্ত্রণা ঠান্ডাতে উপশম হয়।
রাসটক্সঃ যেকোনো প্রকার সাধারণ ঘায়ের প্রথম দিকে রাসটক্স একটি খুব উপযোগী ঔষধ। রোগ যন্ত্রণা বিশ্রামে বৃদ্ধি এবং উত্তাপে উপসমূহ এই বিষয়টি নজরে রাখতে হবে। জল লাগলে এই ওষুধের রোগীর রোগ যন্ত্রণা বৃদ্ধি পায়।
মার্ক সলঃ যেকোনো ফোঁড়া বা ঘা তে পূঁজ উৎপন্ন হলে তখন মার্কসলের ক্ষেত্র আসে। এটি একটি ধাতু গত ঔষধ। রোগী শীত এবং গরম ও ভাইয়ের প্রতি সংবেদনশীল থাকে। প্রচুর ঘাম, প্রচুর পিপাসা, প্রচুর লালা স্রাব এই ঔষধের বৈশিষ্ট্য।
হিপার সালফঃ ঘায়ে স্পর্শকাতর বেদনা থাকে। এত ব্যাথা থাকে যে তাতে হাত ছড়ানো যায় না এমনকি কাপড়ের স্পর্শেও ব্যাথা লাগে। রোগ যন্ত্রণা উত্তাপে উপশম। রোগীর শীত বেশি।
সাইলিসিয়াঃ সিলিকা বা বালু থেকে তৈরি এই ঔষধ কি ঘায়ের উপর খুব সুন্দর কাজ করে তবে অবশ্যই লক্ষণ দৃশ্য অনুযায়ী তা ব্যবহৃত হলে। ঘাতে খুব বেশি ব্যথা থাকে না। ও সাধারণত পাতলা ধরনের হয়ে থাকে। গরমে রোগ যন্ত্রণার উপাসনা হয়।
এছাড়াও লক্ষণ বিবেচনায় যে কোন হোমিওপ্যাথিক ঔষধই শরীরে ঘা এর হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার জন্য নির্বাচিত হতে পারে। অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ কেস টেকিং করে এই রোগের জন্য সঠিক ঔষধ নির্বাচন করা সম্ভব। এবং তার ফলে অতি দ্রুত এবং নির্মল ভাবে রোগ আরোগ্য হয়ে যায়।
আরো পড়ুনঃ ক্ষত দ্রুত আরোগ্য না হওয়ার কারণ সমূহ
এই লেখাটি আপনার উপকারে এসেছে কি? আরো নতুন লেখা তৈরির জন্য আর্থিকভাবে অবদান রাখতে পারেন। যেকোন পরিমাণ আর্থিক কন্ট্রিবিউশন করতে নীচের ডোনেট বাটন ব্যাবহার করুন।
[custom_donation]