হার্ট অ্যাটাক এবং হার্টের ব্লকেজ রুখে দিন-ডা. বিমল ছাজেড়। পর্ব-১

0
12

আমার কথাঃ হার্ট অ্যাটাক এবং হার্টের ব্লকেজ রুখে দেওয়ার ব্যাপারে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করা এবং তাদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন “সাওল হার্ট প্রোগ্রাম” এর প্রতিষ্ঠাতা চিকিৎসক জনাব ডাঃ বিমল ছাজেড়। ওনার কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভিডিও লেকচার আছে ইউটিউবে। জনসাধারণের মাঝে এই বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ইউটিউব থেকে হার্টের ব্লকেজ এবং হার্ট অ্যাটাকের ওপর উনার একটি ভিডিও রেকর্ড এর ভাষ্যকে লিখিত আকারে হুবহু এখানে পোস্ট করেছি।

ভিডিওটিতে দেওয়া উনার বক্তব্য কে আমি ৩ টি পার্ট করে ধারাবাহিক ভাবে এই ব্লগে প্রকাশ করব। ধারাবাহিক এই পর্বগুলো পাঠ করার জন্য সকলের প্রতি আমন্ত্রণ রইল। হার্ট এটাক এবং হার্টের ব্লকেজ কে রুখে দিয়ে আমারা সকলেই যেন বিজয়ী হতে পারি এই লক্ষ্যে আমাদের যাত্রা হোক।

হার্ট অ্যাটাক এবং হার্টের ব্লকেজ রুখে দিনঃ

এই লেখাটি থেকে যে সকল বিষয়ে জানা যাবে সংক্ষেপে সেই বিষয়বস্তু গুলো হলঃ
হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ, হার্ট অ্যাটাক, হার্ট অ্যাটাক এর লক্ষণ, হার্ট অ্যাটাক কেন হয়, হার্ট ব্লক হওয়ার লক্ষণ, হার্ট ব্লক দূর করার উপায়, হার্ট ব্লক এর লক্ষণ, হার্ট ব্লক থেকে বাঁচার উপায়, হার্ট ব্লক রোগীর খাবার, অপারেশন ছাড়া হার্ট ব্লক দূর করার উপায় ইত্যাদ সহ আরো অনেক বিষয়।
হার্ট অ্যাটাক ছবি
হার্ট অ্যাটাক ছবি
ডা. বিমল ছাজেড় স্যার এর বক্তব্যঃ
হার্টের সাইজ কত?
উত্তরঃ ৩০০ গ্রাম। একটি আপেলের মত। হার্টের কাজটা কি?
উঃ পাম্প করা।
কি পাম্প করবে?
উঃ ব্লাড কে।
কোথায়?
উঃ পুরো শরীরে ব্লাডকে পাম্প করবে। হার্ট কতবার পাম্প করে?
উঃ ১ মিনিটে ৭২ বার পাম্প করে। ১ ঘন্টায় ৪,৩০০ বার। ২৪ ঘন্টায় ১,০০,০০০ বার। মনে রাখবেন আপনাদের সবার হার্ট নেক্সট ২৪ ঘন্টার মধ্যে ১ লক্ষ বার পাম্প করবে।
আচ্ছা তার মধ্যে একটা ব্রেক দেওয়া যেতে পারে? দুই মিনিটের?
উঃ না। ব্রেক দিলে পেসেন্ট ইমিডিয়েট মারা যাবে। মনে রাখবেন যতদিন আপনি বেঁচে থাকতে চান প্রতিদিন হার্ট ১,০০,০০০ বার পাম্প করবে।
 
১ ইঞ্চি মোটা একটি টিউব হার্ট থেকে বেরিয়ে পুরো বডিকে ব্লাড সাপ্লাই করে। যেমন বিল্ডিং এর উপরে জলের ট্যাংক রাখা থাকে। সেখান থেকে একটা পাইপ বেরোয়। আর ওই পাইপটা পুরো বিল্ডিংয়ে এক একটা বাথরুমে কিচেনে জল সাপ্লাই দেয়। সেরকম হার্টও সারা শরীরে প্রথমে রাইট হ্যান্ড কে দিল, তারপর ব্রেন কে দিল, তারপর লেফট হ্যান্ড কে দিল।

টিউবটা ঘুরে গেল। গিয়ে হার্টের পেছনে ঢুকলো। সেখান থেকে চেস্টকে সাপ্লাই করে পেটে এলো। পেটে আগে স্টোমাককে সাপ্লাই করবে। তারপর লিভার কে সাপ্লাই করবে। দুটো কিডনিকে সাপ্লাই করবে। তারপর স্মল ইন্টেস্টাইন,লার্জ  ইন্টেস্টাইন কে সাপ্লাই করবে। তারপর দুটো পা কে সাপ্লাই করবে। মানে একবার হার্ট পাম্প করে দিল, পুরো বডিতে ব্লাড পৌঁছে গেল। এই হলো হার্টের কাজ। আর এই ব্লাড থেকে পুরো বডি অক্সিজেন পায়।
আচ্ছা হার্ট যখন পুরো বডিকে ব্লাড দেবে নিজের জন্য অক্সিজেন দরকার কি? নাকি দরকার নেই?
উঃ হার্টকে নিজের জন্যেও অক্সিজেন দরকার। আর এই অক্সিজেন টা কোথা থেকে আসবে? হার্ট যখন পুরো বডিকে ব্লাড সাপ্লাই দেয় তখন নিজের জন্য তিনটে টিউব নিয়ে নেয়। আর এই তিনটে টিউব এর নাম হল করনারি আর্টারী। একটা রাইট সাইডে এটাকে বলা হয় রাইট করোনারি আর্টারি(RCA)। আর লেফ্ট সাইডে দুটো ডিভিশন। প্রথমে একটা টিউব বেরোবে, পরে এটার দুইটা ডিভিশন হয়ে যাবে। একটা পেছনের দিকে চলে গেল। আর একটা সামনের দিকে আসলো। সামনের দিকে যেটা আসলো তার নাম Left anterior descending (LAD). আর পেছনেরটা LCX.
এই তিনটি টিউব থেকে হার্ট ব্লাড পায়।

আর হার্টের অসুখের মানে কি জানেন আপনি? এর মানে হলো এই তিনটি টিউবের ভিতরে চর্বি/ফ্যাট/কোলেস্টেরল জমে যায় আর ধীরে ধীরে হার্টের ব্লাড সাপ্লাই টা কমে যায়। একেই বলা হয় হার্টের অসুখ। আর এই ব্লাড সাপ্লাই যেদিন বন্ধ হয়ে যাবে সেদিন হার্টটাও বন্ধ হয়ে যাবে। হার্ট অ্যাটাক হয়ে যায়। আর এই অসুখটাই এখন বিশ্বের সবথেকে বড় অসুখ। 

এই টিউব গুলো কত মোটা?
উঃ বাচ্চারা পেন্সিলে লেখে সেরকম তিন থেকে চার মিলিমিটারের হয় হার্টের টিউবটা।
আচ্ছা ভাবুন তো হার্টের এই টিউবে ব্লকেজটা তৈরি হতে কত দিন লাগবে? এক সপ্তাহ? এক মাস! এক বছর? পাঁচ বছর?
উঃ বছরের পর বছর লাগবে। 
ব্লকেজটা শুরু কখন হবে?
উঃ বাচ্চা জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে ব্লকেজটা শুরু হবে না। বাচ্চা জন্মাবে। ধীরে ধীরে বাড়বে। যতদিন বাড়বে ততদিন চর্বি খেলে কোন অসুবিধা নেই। যেই বাড়তে বাড়তে ১৮-২০ বছর বয়স হবে, তখন ওর বাড়া বন্ধ হয়ে যাবে। এরপরে যে এক্সট্রা ফ্যাট তার কোন দরকার নেই। কেননা ওই এক্সট্রা ফ্যাটটা আমাদের বডির ভেতরে যাবে আর যেখানে সেখানে ডিপোজিট করবে। মোটা হয়ে যাবে মানুষ, আর ভেতরে ব্লকেজ তৈরি হবে। ধরে রাখুন ১৮ থেকে ২০ বছর বয়সে এই ব্লকেজ শুরু হল আর একজন মানুষ ৬০ বছরে জানতে পারল সে হার্টের পেশেন্ট। 

তার মানে কত বছর লাগলো?
উঃ তার মানে ওকে ৪০ বছর লেগেছে ব্লকেজ জানতে।
এখন ৫০% বন্ধ হয়ে গিয়েছে কিন্তু পেশেন্টের কোন কষ্ট নেই। কেন কষ্ট নেই? কেননা ৫০% এখনো ওর বাকি আছে। এই ৫০% ওর ব্লাড প্রচুর দিয়ে থাকবে। মনে রাখা উচিত আমাদের হার্টের দরকার কেবল ১০% ২০% আর ৩০% এই তিন রকম।
কেন ভাবুন তো?
১) আমাদের হার্টের দরকার ১০% যখন মানুষ বসে থাকবে।
২) যখন হাঁটতে শুরু করবে তখন ২০% ।
৩) আর যখন দৌড়াবে তখন ৩০% ।
যদি ৫০% ব্লকেজ আছে তাহলে ৫০ খোলা আছে। পেশেন্ট দিব্যি দৌড়াতে পারবে। ওর কোন কষ্ট হবে না। যেদিন পেসেন্ট ৭০% ব্লকেজ ক্রস করে যাবে সেদিন কষ্ট শুরু হয়ে গেল। কেন? ওই যে হার্টের দরকার ১০, ২০ আর ৩০ শতাংশ রক্ত।
সেদিন পেশেন্ট এসে বলবে স্যার আমি যদি দৌড়াতে থাকি তাহলে আমার বুকে ব্যথা হয়ে যাবে।
আমি যদি হাটতে যাই যদি বুকে ব্যথা হয় তাহলে ৮০ এর উপরে ব্লকেজ।
যদি বাথরুম যেতে যেতে ব্যথা হয় তার মানে ৯০ এর উপরে ব্লকেজ। 
মনে রাখবেন হার্টের পেশেন্ট ৭০ পর্যন্ত ব্লকেজ বুঝতেই পারবে না-দৌড়াতে পারবে।
আচ্ছা যখন পেশেন্ট এসে বলল, আমি যখন দৌড়াতে যাই, বুকে ব্যথা হয়ে যায়। শ্বাসকষ্ট হয়। গলায় চোকিং মনে হয়। তখন আমি জানতে পারি পেশেন্টের ৭০ এর উপরে ব্লকেজ আছে। আর যেদিন বলে হাটতে গিয়ে সেইম ব্যথা, সেইম কষ্ট( এই কষ্টটাকে মেডিকেলের ভাষায় বলা হয় Angina pectoris) বুঝতে পারি ৮০ এর উপরে ব্লকেজ।

 

আচ্ছা একটা কথা ভাবুন আমার কাছে পেসেন্ট পৌঁছাবে কবে? ৭০ এর আগে নাকি ৮০ এর পরে? পেশেন্ট আমার কাছে ৮০ এর পর এসে বলবে, স্যার আমার এনজাইনা হচ্ছে। আমার কষ্ট হচ্ছে। এই হল হার্টের অসুখ। 

 

আচ্ছা ধরে নিন ২০ বছরে ব্লকেজ শুরু হয়েছে। আর ৬০ বছর বয়সে জানতে পারল ও হার্টের পেশেন্ট। তাহলে কত বছরে লাগল? তার মানে ৪০ বছর লাগলো এই ব্লকেজটা বানানোর জন্য। ৪০ বছরে ৮০% ব্লকেজ। তার মানে ২ পার্সেন্ট প্রতি বছর এই ব্লকেজটা বাড়বে।

হার্টের অসুখের মানে হলো যে, হার্টের নিজের ব্লাড সাপ্লাই এর ভেতরে ব্লকেজ হয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে হার্টের ব্লাড সাপ্লাই টা কম হয়ে যাচ্ছে। 

 

কি টেস্ট করালে এই ব্লকেজ ধরা যেতে পারে? 

১) সিটি এনজিওগ্রাফিঃ বিনা তার ঢুকিয়ে ব্রেনের সিটিস্ক্যানের মতো হার্টের সিটি স্ক্যান করা। মাত্র দুই মিনিটে অনেক অল্প দামে এই টেস্ট করা যায়। কোন কাটাছেঁড়া ব্যতিরেকে। এটিই সর্বোত্তম। (অনেক ডাক্তার স্বীকার করে না)

২) নরমাল এনজিওগ্রাফিঃ এটি তার ঢুকিয়ে করতে হয়। এটিও সম্পূর্ণ একুরেট নয়।

কোন টেস্টেই ব্লকেজ একুরেট পাওয়া যায় না। বলা হয় ৭০, ৮০, ৯০ ।

ব্লকেজে সবথেকে খারাপ কি হতে পারে? 

উঃ সব থেকে খারাপ হতে পারে হার্ট এটাক। এটাকে বলা হয় কার্ডিয়াক এরেস্ট(Cardiac arrest)। এটাকে আমাদের মেডিকেলের ভাষায় বলে করনারি থ্রম্বসিস(Coronary thrombosis) বা অ্যাকিউট মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্রাকশন। এনিওয়ে ঐ টার্মে যাবেন না। ভেবে রাখুন এটা হার্ট অ্যাটাক। 

হার্ট এটাক মানে কি? 

হার্ট অ্যাটাক ছবি
হার্ট অ্যাটাক ছবি

একটু ভেবে দেখুন তো হার্ট অ্যাটাকের পেশেন্টের কষ্ট কি হয়? কষ্ট হয় বুকে প্রচুর বেশি ব্যথা। তার সাথে শ্বাসকষ্ট। চোকিং। এটা হাঁটলে হবে না। বসে বসে কষ্টটা হবে। আপনি ভেবে রাখুন বসে বসে যদি কারো বুকে ব্যথা হয়ে যায়। বসে বসে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে আর ঘাম হয়ে যাচ্ছে, তাহলে ভেবে রাখুন এটা হার্ট অ্যাটাক। 

কেন?

বসে বসে ওর দরকার ১০% ব্লাড সাপ্লাই। সেটাও নেই।

তার মানে কি? ব্লকেজ মোটামুটি ১০০ পার্সেন্ট! হার্ট এটাকের মানেই হল ব্লকেজ ১০০% । এই ১০০% ব্লকেজটা হতে আপনি জানেন খুব কম সময় দরকার হয়। হার্ট এটাকের একটা পেশেন্ট কালকে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে, আর আজকে ওর হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেল। ১ মিনিট লাগে হার্ট অ্যাটাক হতে। 

 

আচ্ছা এই হার্ট এটাকে যেখানে ১০০% ব্লকেজ দরকার সেটা কি করে সাডেনলি(Suddenly) হয়ে যায়?

যদি কারো ৮০ ব্লকেজ থাকে ও ১০০% যদি করতে হয় তাহলে তো ১০ বছর লাগা উচিত ২ পার্সেন্ট করে বাড়তে থাকলে? তাহলে কি করে এই হার্ট অ্যাটাক হয়? 

দেখুন হার্টের যে ব্লকেজটা আছে এর উপরে একটা পর্দা থাকে। এই যে পর্দাটা এটাকে বলা হয় এন্টিমাল মেমব্রেন। আর যদি ব্লকেজ বাড়তে থাকে তাহলে পর্দাটার কি হবে বুঝতে পারছেন? পর্দাটা ধীরে ধীরে টান পড়বে আর পর্দাটা টান পড়তে পড়তে একদিন পর্দাটা ছিঁড়ে যাবে। আর ছিড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিভাবে জানেন তো? এখান থেকে কিছু কেমিক্যাল রিলিজ হয়। আর রক্ত ওর সঙ্গে মিক্সড হয়ে রক্তটা জমাট বেঁধে যায়। আর রক্ত জমাট বেঁধে গেলে তাকে বলা হয় ক্লট(Clot)। আর এখানে যদি একটা ক্লট এসে গেল কত ব্লকেজ হয়ে গেল? ভাবুন আপনি? এটা হয়ে গেল ১০০% । এটাকে বলা হয় হার্ট অ্যাটাক। এই হার্ট অ্যাটাক হতে কতক্ষন লাগলো বুঝতে পারছেন? ক্লটিং হতে যতক্ষণ টাইম লাগে। 

 

আচ্ছা ক্লটটা হল কেন?

উঃ কেমিক্যাল রিলিজ হলো বলে। 

কেমিক্যাল রিলিজ হলো কেন? 

উঃ পর্দা ছিড়ে গিয়েছে বলে।

পর্দা কেন ছিঁড়লো? 

উঃ ব্লকেজ বাড়ছিল। 

মানে হার্টের পেসেন্ট যদি ব্লকেজকে বাড়াতেই থাকে, বাড়াতেই থাকে একনা একদিন পর্দাটা ছিড়বে। হার্ট অ্যাটাক হবে।

 

আমার মন্তব্যঃ

হার্ট এটাক ও হার্টের ব্লকেজ রুখে দেওয়ার জন্য প্রতিভাবান চিকিৎসক ডা. বিমল ছাজেড় এর এই উদ্যোগ ও কর্ম প্রচেষ্টা সত্যিই মহত্ব ও প্রশংসার দাবিদার। উনার পরামর্শ গুলো আমরা যদি উপলব্ধি করতে পারি এবং যথাসম্ভব মেনে চলতে পারি তবে আমাদের হার্টের এই সকল রোগই হবেনা আশা রাখা যায়।

সকলের সুস্থ্য, সুন্দর ও সুখী জীবন কামনা করছি।

 

এর পরের পর্বঃ হার্ট অ্যাটাক এবং হার্টের ব্লকেজ রুখে দিন-ডা. বিমল ছাজেড়। পর্ব-২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here