হেঁচকি ওঠার কারণ এবং হেঁচকি থামানোর উপায় নিয়ে আজকের পোষ্টে আলোচনা করব।
হেঁচকি কাকে বলে?
হেঁচকি ওঠার কারণ হলো ডায়াফ্রাম এর spasm বা খিঁচুনি। ডায়াফ্রাম এর খিচুনির কারণে ভোকাল কর্ডের সংকোচন এবং সেই সংকোচনের প্রভাবে হিক শব্দ হওয়াকে হেঁচকি বলে।
হেচকি উঠার কারণঃ
ডায়াফ্রাম নামক একটি পেশী আমাদের বুক এবং পেটের মাঝ বরাবর অবস্থান করে আমাদের বুক ও পিঠকে দুই ভাগে ভাগ করেছে। এই ডায়াফ্রাম এর উপরের ভাগে আছে হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস ইত্যাদি। লিভার, কিডনি, পাকস্থলী এগুলো ডায়াগ্রামের নিচের ভাগে অবস্থিত। কোন কারণবশত এই ডায়াগ্রাম বা খিচুনি হলে তার আক্ষেপ এর একটা তরঙ্গ ভোকাল কর্ড পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয় ফলে তার প্রভাবে আমাদের গলার ভোকাল কর্ড এবং ওই বরাবর একটা নির্দিষ্ট বিরতিতে সংকোচনের ভাব তৈরি হয়। তার ফলে হিক্ ধরনের একটা শব্দ তৈরি হয়ে থাকে। একেই হিক্কা বা হেঁচকি বলে। অজীর্ণ পীড়া এবং কলেরার দোষ থেকেও অনেক সময় হিক্কা হয়ে থাকে।
হেঁচকি থামানোর উপায়ঃ
হেঁচকি উঠলে কি করতে হয় তা জানা থাকলে আমরা হেঁচকি ওঠার কারণ ও প্রতিকার বিষয়ে অতি দ্রুত সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারব।ফলে দ্রুত হেঁচকির থামানোর উপায় বা সমাধান আমরা বের করতে পারব। তাই আমাদের হেচঁকি বিষয়ক সাধারণ শিক্ষা সকলেরই থাকতে হবে।
আমরা পূর্বেই জেনেছি অতিরিক্ত হেঁচকি ওঠার কারণ হলো আমাদের ডায়াফ্রাম এর স্প্যাজম। এছাড়াও কখনো কখনো স্নায়বিক কারণেও এই হেঁচকি সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই হেচকি কমানোর উপায় হল এই সকল বিষয়ের উপরে নজর রেখে চিকিৎসা করা বা ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আর এটি করতে হবে আমাদের যথেষ্ট সচেতন ও দ্রুত ভাবে যাতে দ্রুত রোগীর কষ্ট দূর করা যায়।
হেঁচকি বন্ধের ঔষধঃ
হেঁচকি বন্ধের জন্য হোমিওপ্যাথিক ঔষধ নির্বাচন করতে হলে অবশ্যই রোগের লক্ষণ সাদৃশ্যে তা করতে হবে। হেঁচকি বন্ধের ঔষধ নির্বাচনে প্রাথমিক কিছু হোমিওপ্যাথিক ওষুধের নাম করা যায় যেগুলো লক্ষণ সাদৃশ্য প্রয়োগে খুব দ্রুত হেচকি বন্ধ হতে পারে। নিচে আমি বেশ কিছু ঔষধের উল্লেখ করলাম যেগুলো থেকে রোগীর রোগ লক্ষণ অনুযায়ী ঔষধ নির্বাচনের চেষ্টা করা যেতে পারে।
নাক্স ভামিকাঃ অজীর্ণের দোষ সেতু বা স্নায়বিক কারণে হিক্কা হলে নাক্স ভমিকা এই সকল ক্ষেত্রে সুন্দর ক্রিয়া করে। তবে রোগীর ধাতুগত লক্ষণ এবং লক্ষণের সাথে মিল রেখেই ঔষধটি নির্বাচন করতে হবে। এছাড়াও মাত্রাতিরিক্ত ভোজন, বিভিন্ন উত্তেজক ও টনিক ঔষধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াতে হেঁচকি হলেও নাক্সের ভমিকা(Nux Vomica)কে স্মরণ করতে হবে। ঠান্ডা জল পান করলে নাক্স ভূমিকার হেচঁকি খুব বেড়ে যায়।
সাইকিউটা ভিরসাঃ বিরামহীন হেঁচকি। যদি বা কিছুটা সময় হেচকি বন্ধ হয় আবার কিছুক্ষণ পর তা শুরু হয়। এভাবে কখনো কখনো একটানা ৪-৫ দিন বা সপ্তাহ কাল যাবত হেঁচকি চলতে থাকে। এমনকি ঘুমের মধ্যেও অনেক সময় রোগীর হেঁচকি চলতে থাকে। কখনো কখনো হেচঁকি রোগটি হওয়ার পেছনে কৃমির লক্ষণ থাকতে দেখা যায়। কৃমির লক্ষণ আরো যে সমস্ত ঔষধে আছে তার ভেতরে সিনা, স্যান্টোনাইন, টিউক্রিয়াম, স্যাবাডিলা অন্যতম।
ইগ্নেসিয়াঃ কিছু খেলে যদি হেচকি বৃদ্ধি পায় সেটা হতে পারে শক্ত বা তরল যে কোন প্রকারের খাবার তবে ইগ্নেশিয়া ঔষধটির কথা বিবেচনা করতে হবে।
আর্সেনিক এল্বামঃ হেঁচকির সাথে যদি আর্সেনিকের ধাতুগত লক্ষণ এর মিল থাকে যেমন অল্প অল্প করে বারবার পিপাসা ও জলপান এবং তাতে উপশম। প্রবল অস্থিরতা তার সাথে মৃত্যুভয়। উত্তাপে সকল কষ্টের উপশম(মাথাব্যথা ব্যথিত) তবে সেখানে আর্সেনিক এল্বাম সুন্দর ক্রিয়া করবে। এর সাথে সাথে আর্সেনিক আইওডের দিকেও নজর রাখা যেতে পারে।
টিউক্রিয়াম মেরাম ভেরামঃ যদি কৃমির উপদ্রব থেকে হেচঁকির উৎপত্তি হয় তবে এই ঔষধটি দারুন ক্রিয়া করবে। বলা হয় যে, কোন কিছুতেই যদি দুর্দমনীয় হেচঁকির উপশম না হয় তবে বুঝতে হবে যে রোগীর পেটে কৃমি আছে। তখন টিউক্রিয়াম ঔষধটি কাজে আসবে।
লাইকোপোডিয়ামঃ পেট ফাঁপা বা পেটে বায়ুর থেকে হেচঁকির উৎপত্তি হলে এবং ধাতুগত লক্ষণ থাকলে হেঁচকি বন্ধ করার মেডিসিন হিসেবে লাইকোপোডিয়াম খুব সুন্দর ক্রিয়া করে। এ সকল ক্ষেত্রে কার্বোভেজ কেও বিবেচনায় রাখতে হবে। এছাড়াও হোমিওপ্যাথিক সদৃশ্য নীতি অনুসারে ধাতু গত লক্ষণ হিসেবে হেঁচকি বন্ধের ঔষধ হিসেবে যেকোনো হোমিওপ্যাথিক ঔষধই কার্যকরী হতে পারে।
হোমিওপ্যাথিক হেঁচকি বন্ধের ঔষধ সেবনের পাশাপাশি এইমিল নাইট্রেট এর মাদার টিংচার একখণ্ড কাপড় বা রুমাল এ ঢেলে বা কোন পাত্রে ঔষধ নিয়ে নাক দ্বারা ঘ্রাণ নিলে তাতে আরও দ্রুত হেঁচকির উপশম হবে।
জিনসেং মাদার টিংচার পাচ সাত ফোটা এক কাপ পরিমাণ জলে মিশিয়ে কিছুক্ষণ বাদে বাদে দুই চারবার সেবন করলে দ্রুত হেঁচকির উপশম হবে।
ভিনিগার সামান্য মাত্রায় জলসহ ১৫/২০ বিনিত অন্তর ২/৪ বার সেবনে হেচঁকির উপশম হয়।
প্রবল হেচঁকিতে ডাঃ শুসলার আর তার বায়োকেমিক ম্যাগনেসিয়া ফস ঔষধটি কে ৬x বা ১২x মাত্রায় উষ্ণ গরম জলের সাথে মিশিয়ে ১০/১৫ মিনিট অন্তর অন্তর দুই চার বার সেবন করতে উপদেশ দিয়েছেন।
ঘরোয়াভাবে হেঁচকি দূর করার উপায়ঃ ডাবের জল উষ্ণ গরম করে পান করলে হেঁচকির উপশম হতে পারে। কিছুটা প্রাকৃতিক কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃশ্বাস দ্বারা গ্রহণের ফলে প্রবল হেচঁকির উপশম হয়।
একটি পলিথিন বা কাগজের ব্যাগের মধ্যে মুখ প্রবেশ করিয়ে তাতে কয়েকবার শ্বাস প্রশ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগ করতে হবে। তাতে ওই ব্যাগের মধ্যে অক্সিজেন শেষ হবে ও ব্যাগটি কার্বন-ডাই-অক্সাইড দ্বারা পূর্ণ হবে। তখন ওই কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃশ্বাস দ্বারা টেনে নিলে হেচঁকির উপশম হয়। শীতকালে লেপের ভিতরে মাথা মুখ ঢেকে শ্বাস প্রশ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগ করলে হেঁচকির উপশম হতে পারে।
হেচকি সম্বন্ধে আরও কিছু প্রশ্নোত্তরঃ এখানে হেচঁকির সংশ্লিষ্ট আরো কিছু কমন প্রশ্ন ও উত্তর যুক্ত করা হল।
যেমনঃ
১) বাচ্চাদের হেঁচকি কেন হয়?
২) নবজাতকের হেঁচকি বন্ধ করার উপায়।
নবজাতকের হেঁচকি কেন হয়ঃ
সাধারণত নবজাতকের দুইটি কারণ থেকেই হেঁচকি ওঠতে দেখা যায়। একটি হলো সিস্টেমিক ডিজঅর্ডারডার এবং অপরটি হল বায়ুর প্রকোপ। বডি মেকানিজম এর ইন্টারনাল সিস্টেম এর যে কোন পরিবর্তন জনিত কারণে বাচ্চাদের হেচঁকি হতে পারে। আবার বাচ্চা যখন মায়ের স্তন থেকে দুধ টেনে খায় তখন কখনো কখনো খানিকটা বাতাস খেয়ে নেয়। এই বায়ু পেটের ভিতরে গিয়ে জমা হয়ে তা উর্ধগামী চাপ প্রদান করে। এই বায়ুর চাপের প্রভাব থেকে ছোট বাচ্চাদের হেচঁকির সমস্যা দেখা দেয়। এই সকল ক্ষেত্রে একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর বাচ্চাকে সোজা করে বসিয়ে পেটের বায়ু যেন সহজে বের হতে পারে সেই চেষ্টা করতে হবে।
নোটঃ হেঁচকি ওঠা সাধারণত ক্ষতিকর নয়। এটি গুরুতর কোন রোগ লক্ষণ সৃষ্টি না করেই কিছুক্ষণের মধ্যেই কোন চিকিৎসা ব্যতিরেকেই আরোগ্য হয়ে যায়। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে এই হেঁচকি হয়তো দুই/তিন দিন বা সপ্তাহ জুড়ে অনবরত চলতে থাকে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা কর্তব্য।
আরো পড়ুনঃ ধুমপান ছাড়ার উপায়ঃ সর্বোচ্চ ৩ সপ্তাহে ধুমপান ছাড়ুন