মহাত্মা শ্যামুয়েল হ্যানিম্যানের জীবনী: জী দীর্ঘাঙ্গী

0
453

মহাত্মা শ্যামুয়েল হানিম্যানের জীবনী পাঠ যেমন শিক্ষামূলক তেমনি সুখ পাঠ্য। এইরকম মনীষীদের জীবনের নানা ঘটনাবলি ও জীবন প্রবাহ থেকে আমরা নিত্য নতুন শিক্ষা লাভ করে থাকি। আমাদের লক্ষ্য আরো সুনির্দিষ্ট হয়। আমরা অনুপ্রেরণা লাভ করে নিজ নিজ কর্মে অধ্যাবসায় সহকারে অগ্রসর হতে পারি। তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থেকে জ্ঞান অর্জন করে আমরা আমাদের চরিত্র গঠনে সহায়তা পাই। আমরা তাদের জীবনালেক্ষ্য পাঠ করার সাথে সাথে সেই সময়ের ইতিহাস সম্পর্কেও ধারণা পাই।

প্রতিকূলতা এবং সমস্যা তারা কিভাবে মোকাবেলা করতেন তা উপলব্ধি করে আমরাও আমাদের বাস্তব জীবনের সমস্যা ও প্রতিকূলতার ক্ষেত্রে সেগুলোর প্রয়োগ করতে পারি। মোটকথা মনীষীদের জীবনী পাঠের দ্বারা আমাদের যে মূল্যবোধ গড়ে ওঠে তার দ্বারা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এবং সর্বোপরি সমগ্র বিশ্বই উপকৃত হতে পারে। আমাদের মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত হয়ে থাকে এবং আমরা কর্মে একনিষ্ঠতা লাভ করি।

মহাত্মা হ্যানিম্যানের জীবনীঃ

ডা. জী দীর্ঘাঙ্গী স্যারের নিজ হাতে লেখা মহাত্মা শ্যামুয়েল হানিম্যানের জীবনী এখানে তুলে ধরছি।

ধর্ম, কর্ম ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে দিগ্বিজয়ী-প্রতিভাশালী যাঁহারা জন্মগ্রহণ করেন, পরম হিতকর আবিষ্কারাদি যাঁহাদের জীবনব্যাপী প্রাণপণ গবেষণার ফল

বলিয়া ইতিহাসে প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাঁহাদের প্রায় সকলেই প্রারম্ভে লাঞ্ছিত, উপেক্ষিত, অপমানিত এমন কি তীব্রভাবে উৎপীড়িত হইয়াছেন। হ্যানিম্যানের জীবনী তাহারই অন্যতম উদাহরণ । যাঁহারা ঐ সকল আবিষ্কারের সুফল ভোগ করেন, তাঁহাদের উচিত, পূর্বপুরুষগণের উক্ত অত্যাচারের জন্য ভগবচ্চরণে ক্ষমা ভিক্ষা করা এবং উক্ত মহাপুরুষগণের জীবনী এরূপভাবে অবগত হওয়াযেন ঐরূপ অত্যাচার আর কোনও আবিষ্কর্তার প্রতি অনুষ্ঠিত না হয়।

হ্যানিম্যানের জীবনী প্রত্যেক সমমতবাদীর ভক্তিসহকারে পাঠ্য এবং তাঁহার মত যত্নসহকারে পালনীয়। তদ্বারা পীড়িত মানবের আর্তনাদ হ্যানিম্যানের প্রতি উচ্চ আশীর্বচনে পরিবর্তিত হইবে এবং হ্যানিম্যানের আত্মা এইটি উপলব্ধি করিয়া তৃপ্ত হইবেন যে বাস্তবিকই তিনি মরজগতে “বৃথা জীবন যাপন করেন নাই” ।

হ্যানিম্যানের জীবনী
হ্যানিম্যানের জীবনী

স্যামুয়েল কৃষ্টিয়ান ফ্রেডারিক হ্যানিম্যান ১৭৫৫ খৃষ্টাব্দের ১০ই এপ্রিল, রাত্রিকালে, ইউরোপের জার্মান রাজ্যে, স্যাক্সনির অন্তঃপাতী মিসেন নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার পিতার নাম কৃষ্টিয়ান গটফ্রায়েড এবং মাতার নাম জোহানা কৃষ্টিয়ান হ্যানিম্যান। যে বাটিতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন, তাহার নাম এক হাউস। বর্তমানে সে বাটী নাই, এক্ষণে তৎস্থলে একটিভোজনালয় স্থাপিত হইয়াছে। ভোজনালয়ের প্রবেশপথের উপর লেখা আছে—

“হোমিওপ্যাথির আবিষ্কর্তা ফ্রেডারিক হ্যানিম্যান এই স্থানে জন্মগ্রহণ করেন।” ইহারই এক কোণে হ্যানিম্যানের বক্ষঃ পর্যন্ত এক প্রতিমূর্তি স্থাপিত হইয়াছে ।

হ্যানিম্যানের পিতা চীনামাটির বাসনের উপর চিত্রকার্য করিয়া জীবিকা উপার্জন করিতেন, তথাপি তিনি ৫ বৎসর বয়স্ক হ্যানিম্যানকে প্রত্যহ নির্দিষ্ট সময়ে চিন্তা করিতে শিক্ষা দিতেন। তিনি উপদেশ দিতেন, “সকল বিষয়ই পরীক্ষা করিয়া দেখিবে, পরে যেটি সত্য তাহাই গ্রহণ করিবে।” হ্যানিম্যান অল্প বয়সেই গ্রাম্য পাঠশালায় প্রবেশ করেন। তিনি অত্যন্ত প্রতিভাশালী ছিলেন।

দ্বাদশ বৎসর বয়সেই তাঁহার শিক্ষক মাষ্টার মুলার তাঁহাকে অন্যান্য ছাত্রগণকে গ্রীক ভাষার প্রাথমিক অংশ শিক্ষা দিবার ভার দিয়াছিলেন । এই সময়ে তাঁহার পিতা তাঁহাকে পাঠশালা হইতে ছাড়াইয়া লইবার প্রস্তাব করেন। তাহাতে মাষ্টার মুলার হ্যানিম্যানের জন্য কোনও বেতন দিতে হইবে না বলিয়া তাঁহাকে রাখিয়া দেন। ষোড়শ বৎসর বয়সে হ্যানিম্যান মিসেন বেসরকারী বিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন । মধ্যে হ্যানিম্যানের পিতা বহুবার তাঁহাকে বিদ্যালয় ত্যাগ করাইয়া অন্য কার্যে নিযুক্ত করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু শিক্ষকগণের অনুরোধে মহাত্মা হ্যানিম্যানের জীবনী হানিম্যানকে বিদ্যালয়ে পুনঃপ্রেরণ করিয়াছিলেন।

হ্যানিম্যান রাত্রিকালে প্রদীপ জ্বালিয়া পাঠ করিতেন। তজ্জন্য তৈলের ব্যয়ভার বহন করিতেও তাঁহার পিতা বিরক্ত হইতেন। হ্যানিম্যান একটি মাটির প্রদীপ নির্মাণ করিয়া গোপনে গৃহের এক কোণে বসিয়া পাঠ করিতেন। হ্যানিম্যান এইরূপে ২০ বৎসর বয়সেই ল্যাটিন, গ্রীক, হিব্রু, ইতিহাস, পদার্থ-বিজ্ঞান প্রভৃতির অল্পবিস্তর শিক্ষালাভ করিয়াছিলেন। হ্যানিম্যানের পিতা বুঝিলেন, এক্ষণে হ্যানিম্যানের অদম্য জ্ঞানলিপ্সাকে আর বাধা দেওয়া উচিত নয়। তন্নিমিত্ত ১৭৭৫ খৃষ্টাব্দে প্রায় ২০ টালার বা ডলার মাত্র সম্বল লইয়া

হ্যানিম্যানকে লিপজিক যাইতে এবং তথায় আপন জীবনের গন্তব্যপথ নির্ধারণ করিতে অনুমতি দিলেন। লিপজিকে তিনি দিবাভাগে বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিতেন এবং রাত্রিকালে ইংরেজী হইতে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করিতেন এবং একজন গ্রীককে জার্মান ও ফ্রেঞ্চ ভাষা শিক্ষা দিতেন। মিসেনে এক ভদ্রলোক তাঁহাকে চিকিৎসা-বিষয়ক বক্তৃতা শুনিবার জন্য বিনামূল্যে টিকেট দিতেন, তথাপি উক্ত অনুবাদকার্যের অনুরোধে তিনি যাইতে পারিতেন না। অতি যত্নের সহিত তিনি অধ্যয়ন করিতেন এবং অর্থসঞ্চয়ের চেষ্টা করিতেন, উদ্দেশ্য—-

ভিয়েনায় গমন করিয়া শিক্ষা করিবার অধিকতর সুবিধা পাইবেন । দুঃখের বিষয় লিপজিকে আসিবার কিছুদিন পরেই তাঁহার সঞ্চিত সমস্ত অর্থ প্রবঞ্চকদিগের কৌশলে নষ্ট হয়। ৬৮টি ফ্লোরিনের উপর নির্ভর করিয়া তিনি ৯ মাস কাল অতিবাহিত করেন। পরিশেষে, এম্পারার জোসেফের চিকিৎসক ডাক্তার ভন্ কোয়ারিনের চেষ্টায় হারমানষ্টাডে সিবেনবার্জনের শাসনকর্তা ব্যরন ভন ব্র্যাকেথলের বেসরকারী চিকিৎসক এবং তাঁহারই অমূল্য পুস্তক ও হস্তলিপিপূর্ণ পুস্তকাগারের রক্ষক নিযুক্ত হন।

এই সকল পুস্তক অবিরত পাঠ করিয়া হ্যানিম্যান ২৪ বৎসর বয়সে গ্রীক, ল্যাটিন, ইংলিশ, হিব্রু, ইটালিয়ান, সিরিয়াক, এরাবিক, স্প্যানীশ, জার্মান, চ্যালডেইক ভাষায় বিশেষ দক্ষতা লাভ করেন। ১৭৭৯ খৃষ্টাব্দে এনলার্জেন বিশ্ববিদ্যালয় হইতে হ্যানিম্যান এম-ডি উপাধি প্রাপ্ত হন। ১৭৮২ খৃষ্টাব্দে তিনি দেশাউ নগরের ঔষধ বিক্রেতা কুচলারের কন্যা জোহানা হেনরিয়েটা লিওপোন্ডাইন কুচলারের পানিগ্রহণ করেন। ইহার কিছুদিন পূর্বে তিনি গোমারন ধর্মমন্দিরের অধীনে চিকিৎসক নিযুক্ত হন এবং এইস্থলে অবস্থানকালে “পুরাতন ক্ষত চিকিৎসা” নামক পুস্তক প্রণয়ন করেন ।

পুরাতন চিকিৎসা প্রণালীতে আস্থাহীন হইয়া চিকিৎসা বিষয়ে জার্মানীর মন্ত্রীস্বরূপ হুফিল্যান্ডকে তিনি “চিকিৎসাশাস্ত্রের পুনর্জন্মের প্রয়োজন” শীর্ষক এক পত্র লিখেন এবং ১৭৮৪ খৃষ্টাব্দে গোমারন ধর্মমন্দিরের অধীনে চিকিৎসাকার্য পরিত্যাগ করেন।

গোমারন ত্যাগ করিয়া হ্যানিম্যান ড্রেসডেনের ডাক্তার ওয়াগনারের সহিত বন্ধুত্ব করেন এবং এক বৎসরের জন্য ঐ সহরের হাসপাতালের ভার প্রাপ্ত হন । এই সময়ে হ্যানিম্যান বৈজ্ঞানিক পুস্তকসমূহের অনুবাদকারক এবং রাসায়নিক পরীক্ষক বলিয়া জার্মানীতে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন। ১৭৮৯ খৃষ্টাব্দে হ্যানিম্যান লিপজিকে প্রত্যাবর্তন করিয়া, অনুবাদকার্যে মনোনিবেশ করেন । তিনি যে চিকিৎসাশাস্ত্রের আমূল পরিবর্তন সাধন করিবেন এখনও তাহার কোনও আভাসই পান নাই । বিখ্যাত স্কচ ডাক্তার উইলিয়াম

কালেনের মেটিরিয়া মেডিকার অনুবাদকালে তিনি পেরুভিয়ান বার্ক বা চায়না সেবন করিয়া, সবিরাম জ্বরের লক্ষণ প্রাপ্ত হন। এই সময়ের মধ্যে তাঁহার অনেকগুলি সন্তান-সন্ততি জন্মগ্রহণ করে। ১৭৯১ খৃষ্টাব্দে ব্যয়ভার লাঘবের জন্য তিনি ষ্টটারিজ নামক গ্রামে গমন করেন । দারিদ্র্যই তাহার কারণ। কিন্তু সুস্থ শরীরে ঔষধের পরীক্ষাকার্য চলিতেথাকে। তাঁহার পরিবারের সকলেই এবং বন্ধুবর্গও তাঁহাকে একার্যে সাহায্য করেন। তিনি ছয় বৎসর ধরিয়া বিভিন্ন ভেষজ এবং বিষসমূহের গুণ সুস্থ শরীরে পরীক্ষা দ্বারা এবং প্রাতন ভৈষজ্যবিজ্ঞানে বর্ণিত অভিজ্ঞতা অধ্যয়ন দ্বারা অবগত হইয়া তাহাদের লিপিবদ্ধ করেন। এ পর্যন্ত তাঁহার পরীক্ষিত ঔষধের কার্যকারিতা তিনি ব্যবহারিকভাবে উপলব্ধি করিবার অবসর পান নাই ।

১৭৯৩ খৃষ্টাব্দে তিনি হের ক্লকিং ব্রেংকে উন্মত্ততা হইতে নীরোগ করেন । ১৭৯৬ খৃষ্টাব্দে হুফিল্যান্ড সম্পাদিত “জার্নাল ফর দি প্র্যাকটিসিং ফিসিশিয়ান্স” নামক পত্রিকায় “ঔষধসমূহের শক্তি নির্ণয়ের নূতন প্রথা” শীর্ষক এক প্রবন্ধ লিখিয়াছিলেন।

কোনিগশ্লাটার নামক স্থানে অবস্থানকালে, তথায় স্কার্লেট ফিভারের এক মহামারী হয় । হ্যানিম্যান তাঁহার অভিনব জ্ঞানের পরীক্ষার সুযোগ পাইলেন । তিনি বলিলেন, বেলেডোনা সদৃশ লক্ষণ উৎপাদন করিতে পারে বলিয়াই স্কার্লেট ফিভার আরোগ্যও করিতে পারে। হ্যানিম্যান প্রথমে রোগীকে ঔষধ প্রয়োগে নীরোগ না করিয়া এবং উহার ফল সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ না হইয়া, উহার নাম প্রকাশ করেন নাই। তন্নিমিত্ত তাঁহার শত্রুরা তৎপ্রতি গুপ্ত ঔষধ বিক্রয়রূপ দোষারোপ করেন ।

গোপনে নিজ ঔষধ বিক্রয় করিয়া হ্যানিম্যান আইনবিরুদ্ধ কার্য করেন, এই অপরাধে কোনিগশ্লাটারের ঔষধ বিক্রেতারা তাঁহাকে সেই স্থান ত্যাগ করিতে বাধ্য করেন। ১৭৯৯ খৃষ্টাব্দে হেমন্ত ঋতুতে, তাঁহার পরিবারবর্গ ও দ্রব্যাদি লইয়া একখানি প্রকান্ড মালবাহী শকটে ক্ষুব্ধ অন্তঃকরণে হ্যানিম্যান হ্যামবার্গ যাত্রা করিলেন। যে কোনিগশ্লাটারে জীবনের সুখসূর্যের আভাস পাওয়া গিয়াছিল তিনি তাহাই ত্যাগ করিয়া চলিলেন । পথে যাইতে যাইতে এক নিম্নাভিমুখ স্থানে শকট বিবর্তিত হওয়ায় চালক স্বীয় আসন হইতে প্রক্ষিপ্ত  ও হ্যানিম্যান আঘাত প্রাপ্ত হইলেন ।

তাঁহার কন্যার পদ ভঙ্গ হইল এবং শিশুপুত্র এরূপ আহত হইল যে ক্ষণেকের মধ্যেই তাহার প্রাণবিয়োগ ঘটিল। দ্রব্যাদি জলে পড়িয়া কিয়ৎপরিমাণে নষ্ট হইয়া গেল । হোমিওপ্যাথির আবিষ্কর্তা, আরোগ্যের সত্য মন্ত্রদর্শীর কি শোচনীয় দুর্ভোগ। এই নিমিত্ত তিনি নিকটস্থ মূলহৌসেন নামক গ্রামে বহু অর্থ ব্যয়ে ৬ সপ্তাহকাল অবস্থান করিতে বাধ্য হইলেন ।

ইহার পর তিনি অলটোনা নামক গ্রামে বাস করিতে লাগিলেন, হ্যামবার্গ যাওয়া ১৮০০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত স্থগিত রহিল। এই বৎসর লিপজিকের পুস্তক প্রকাশক ফ্লিশার তাঁহাকে ঔষধের ব্যবস্থাপত্র সমন্বিত একখানি ইংরেজী পুস্তকের অনুবাদ করিতে দেন। তিনি জার্মান ভাষায় উহার সুন্দর অনুবাদ করিয়া উহাতে একটি মুখবন্ধে ঐ মিশ্রণ ব্যবস্থাপত্রের নিন্দাবাদ, উপহাসাদি করায়, উক্ত প্রকাশক আর তাঁহাকে অনুবাদকার্যে নিযুক্ত করিলেন না। পরে তিনি কেবলমাত্র ভন্ হ্যালারের ভৈষজ্যবিজ্ঞান অনুবাদ করেন, ১৮০৬ খৃষ্টাব্দে তাহা প্রকাশিত হইয়াছিল । এই সময়ে তিনি হুফিল্যান্ডের পত্রিকায় বহু প্রবন্ধ প্রকাশ করেন ।

১৮০২ খৃষ্টাব্দে তিনি হ্যামবার্গ হইতে মোলেন নগরে গমন করেন । তথায় তাঁহাকে বাস করিতে দেওয়া হইল না । তজ্জন্য তিনি ম্যাচার্ন গ্রামে গিয়া বাস করিলেন। এইখানে তাঁহাকে পুনরায় দারুণ দরিদ্রতাকষ্ট ভোগ করিতে হয় । কথিত আছে সমস্ত দিন হ্যালারের ভৈষজ্যবিজ্ঞান অনুবাদ করিবার পর যে সময় পাইতেন, সেই সময়ে স্বামী স্ত্রী মিলিয়া, সাবান ক্রয় করিবার অর্থাভাববশতঃ, কাঁচা আলু সহযোগে বস্ত্র পরিষ্কার করিয়া লইতেন । দৈনিক আহারের জন্য রুটির পরিমাণ এত অল্প ছিল যে তাহা প্রত্যেকের জন্য সমান ওজনে ভাগ করিয়া লওয়া হইত।

ম্যাচার্ন হইতে তিনি উইটেনবার্গ গমন করেন, তথা হইতে দেশাউ নগরে গমন করিয়া তথায় মাত্র দুই বৎসর বাস করেন । তথা হইতে তিনি টরগৌ নামক স্থানে ছয় বৎসর বাস করেন। পরে নানাপ্রকার অত্যাচারে প্রপীড়িত হইয়া তিনি লিপজিক গমন করেন।

ঔষধসংক্রান্ত পত্রিকাদিতে তাঁহার এবং তাঁহার প্রবন্ধসমূহের নিন্দাবাদ হইতে থাকায় তৎকালে তাঁহার প্রবন্ধসমূহ সাহিত্য ও বিজ্ঞানবিষয়ক “জেনারেল জার্মান গেজেটে” প্রকাশিত হইয়াছিল ।

হ্যানিম্যানের ঔষধ পরীক্ষার প্রথমাংশ ১৮০৫ খৃষ্টাব্দে ল্যাটিন ভাষায় প্রকাশিত হয়। ১৮১০ খৃষ্টাব্দে অর্গ্যাননের ১ম সংস্করণ মুদ্রিত হয় ইহাতেই তিনি হোমিওপ্যাথি এই নাম ব্যবহার করেন। এই নূতন পুস্তক অর্গ্যাননে তিনি ১০০ পৃষ্ঠাব্যাপী এক মুখবন্ধে তৎকাল প্রচলিত চিকিৎসার সমালোচনা করেন। প্রায় ৬০ পৃষ্ঠায় তিনি হিপোক্রেটিস্ হইতে সিডেনহ্যাম পর্যন্ত চিকিৎসকগণের বচন উদ্ধৃত করেন। ইহাতে তিনি ব্যবহারিকভাবে হোমিওপ্যাথির আলোচনা করেন।

আরোগ্যের প্রাকৃতিক নিয়ম, “সমমত”, তিনি আবিষ্কার করিয়াছেন বলিয়া কখনই দাবী করেন নাই, তিনি দাবী করেন, তিনিই প্রথমে ঐ প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যবহারিক ফল প্রচার করেন।

হ্যানিম্যানের অর্গ্যানন যে তাহার লেখকের উপর অজস্র, অবিশ্রান্ত গালিবর্ষণ আনয়ন করিয়াছিল তাহা বলাই বাহুল্য। তিনি বহুকাল প্রচলিত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করিয়াছিলেন। তৎফলেই তাৎকালিক ঔষধবিষয়ক মাসিক পত্র, পুস্তক প্রভৃতি সকলেই তাঁহার প্রতি উপহাস বা বিদ্রূপবাণ নিক্ষেপ করিতে থাকেন। মূর্খ, অজ্ঞ, হাতুড়িয়া প্রভৃতি ভাষা তাঁহার প্রতি প্রযুক্ত হইত । ১৮১১ খৃষ্টাব্দে তাঁহার পুত্রের নাম দিয়া তিনি ইহার প্রতিবাদ করেন। কিন্তু এই বৎসরেই তিনি মেটিরিয়া মেডিকা পিউরা প্রকাশ করিয়াই তৎপ্রতি দুর্ব্যবহারের উপযুক্ততর উত্তর প্রদান করেন। ঐ বৎসরেই তিনি লিপজিকে প্রত্যাগমন করেন ।

স্বার্থসাধনের জন্যই হ্যানিম্যান তাঁহার নবাবিষ্কৃত চিকিৎসাপদ্ধতি প্রচার করিতে প্রয়াস পাইতেছিলেন, তাঁহার শত্রুগণ এইরূপটি প্রচার করিতেছিলেন । তাঁহার চরিত্রের সহিত পরিচিত কোনও ব্যক্তিই তাহার এতটুকুই বিশ্বাস করতে পারেন না । হ্যানিম্যান এখন বুঝিলেন, সাধারণকে তাঁহার মত শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন । ১৮১১ খৃষ্টাব্দেই তিনি “মেডিক্যাল ইনষ্টিটিউট” নামে তাঁহার বক্তৃতা দিবার স্থান স্থানীয় মাসিক পত্রের বিজ্ঞাপনে প্রকাশ করেন। কিন্তু এই বক্তৃতা দিবার পূর্বে একটি প্রবন্ধ পাঠ করিয়া তিনি মেডিক্যাল ফ্যাকালটীর নিকট তাঁহার বিরুদ্ধ সমালোচনার প্রত্যুত্তর দান করিতে বাধ্য হন। এই প্রবন্ধের নামকরণ করেন “পূর্বপুরুষগণের উদ্‌ভ্রান্তি সম্বন্ধে নিবন্ধ।” বাস্তবিক এই নিবন্ধে হিব্রু, ল্যাটিন, গ্রীক, এরাবিক, ইটালিয়ান, ফ্রেঞ্চ, ইংলিশ, জার্মান হইতে বাক্যাবলীর উল্লেখ করেন এবং ইহা এরূপ সারগর্ভ পান্ডিত্যপূর্ণ হইয়াছিল যে কেহই ইহার প্রতিবাদ করিতে সাহসী হন নাই ।

ইহার পর হ্যানিম্যান প্রতি বুধবার ও শনিবার বেলা ২টা হইতে ৩টা পর্যন্ত বক্তৃতা দিতেন। চিকিৎসা বিদ্যালয় ও আইন বিদ্যালয়ের ছাত্রেরা এবং লিপজিকের নতুন চিকিৎসকগণ সকলেই তাঁহার বক্তৃতা শ্রবণ করিতেন। কয়েকজন যুবক তাঁহার অনুগামী হন এবং আপনাদের উপর ঔষধের পরীক্ষা করিতে থাকেন। এই সময় আবার ঔষধ বিক্রেতৃগণ আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করিলেন । হ্যানিম্যানকে উপস্থিত হইতে হইল । তিনি দেখাইলেন, যাঁহারা ঔষধ বিক্রয় করেন তাঁহারা অনেক ঔষধ একসঙ্গে মিশ্রিত করেন কিন্তু তাঁহার ঔষধ মিশ্র নয় এবং এরূপ ক্ষুদ্র মাত্রায় প্রযুক্ত হয় যাহা ঔষধালয়সমূহের মিশ্রণকারীরা অবগত নহেন। যুক্তি অকাট্য হইলে কি হয়, হ্যানিম্যানের প্রতি আদেশ হইল, প্রত্যেকবার ঔষধপ্রদানের জন্য তাঁহাকে ২০ টালার করিয়া জরিমানা দিতে হইবে।

এই সময়ে আর একটি ঘটনা ঘটিল। প্রিন্স ভন শোয়োজেনবার্গ তাঁহাকে ভিয়েনায় আহ্বান করিলেন। তিনি যাইতে অসম্মত হওয়ায় প্রিন্স লিপজিকে আসিয়া বাস করিতে লাগিলেন কিন্তু ভাগ্যক্রমে হ্যানিম্যানের চিকিৎসাধীন থাকিতে থাকিতে প্রায় ৬ মাসের মধ্যে তিনি সন্ন্যাস রোগে প্রাণত্যাগ করিলেন । ইহার ফলে স্যাক্সন গভর্নমেন্টের অত্যাচার সহ্য করিতে না পারিয়া হ্যানিম্যান ১৮২১ খৃষ্টাব্দে মে মাসের প্রথমেই কোইথেনে গ্র্যান্ড ডিউক ফ্রেডারিকের আশ্রয়ে উপস্থিত হইলেন। ডিউক তাঁহাকে তাঁহার রাজত্বের মধ্যে ঔষধ প্রস্তুত ও প্রদান করিবার অনুমতি দিলেন । এই স্থলেই তাঁহার “ক্রনিক ডিজিজেস্” লিখিত হয়, অর্গ্যাননের শেষের ৪টি সংস্করণ এবং মেটিরিয়া মেডিকা পিউরার শেষের দুইটি সংস্করণও প্রকাশিত হয় ।

১৮২৯ খৃষ্টাব্দের ১৩ই আগষ্ট তারিখে তিনি তাঁহার এম. ডি. উপাধি প্রাপ্তির পঞ্চাশত্তম বার্ষিক উৎসব উপলক্ষে একটি ভোজ দেন। এই সময়েই “জার্মান সেন্ট্রাল হোমিওপ্যাথিক ইউনিয়ন” স্থাপিত হয় ।

ইহার কিছুদিন পরে ৩১শে মার্চ ১৮৩০ খৃষ্টাব্দে হ্যানিম্যানের প্রথম জীবনের দারুণ দুঃখদুর্দশার অংশভাগিনী এবং গভীর গবেষণার সহকারিণী প্রথমা পত্নী ইহলোক ত্যাগ করেন। ইহার গর্ভে ১১টি সন্তানসন্ততি জন্মগ্রহণ করেন । কন্যারাই এখন হ্যানিম্যানের গৃহকার্যের ভার গ্রহণ করিলেন ।

১৮৩২ খৃষ্টাব্দে হ্যানিম্যান ওলাউঠা রোগের উপযোগী কয়েকটি ঔষধ প্রচার করেন কিন্তু তিনি একটিও ওলাউঠা রোগী দেখেন নাই । ১৮৩৩ খৃষ্টাব্দে জানুয়ারী মাসে হ্যানিম্যানের একটি প্রিয় আশা পূর্ণ হইয়াছিল, লিপজিকে একটি হোমিওপ্যাথিক হাসপাতাল স্থাপিত হইয়াছিল । এতদিনে তাঁহার মতবাদের যথার্থ পরীক্ষার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান হইল ।

১৮৩৫ খৃষ্টাব্দে ২৮শে জানুয়ারী হ্যানিম্যান মাডাম মিলানীর পাণিগ্রহণ করিয়া প্যারী গমন করেন । কিন্তু ইহার ফলে কোনও সন্তান জন্মে নাই । প্যারীতে ৮ বৎসর অবস্থানকালে তিনি ৪০,০০,০০০ ফ্রাঙ্ক চিকিৎসাসূত্রে উপার্জন করেন।

১৮৪৩ খৃষ্টাব্দে ২রা জুলাই রবিবার প্রাতঃকালে হ্যানিম্যান অমরধামে প্রস্থান করেন। মৃত্যুকালে মৃদুস্বরে তিনি বলিয়াছিলেন—”আমি বৃথা জীবনধারণ করি নাই।”

শুধু সুখপাঠ্য হিসেবেই নয় জীবন গঠনে এবং ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লাভ করতে হানিম্যানের জীবনী সহ বিভিন্ন মনীষীদের লেখা বারংবার পাঠ করা উচিত আমাদের। এই সকল মহান মহাতমাদের জীবনের গল্প গুলো আমাদের জীবন অনুশীলনে অনেক সহায়তা করে থাকে। আমাদের মেধা, মনন ও চিন্তাশীলতা গঠনেও দারুণ ভূমিকা রেখে থাকে। তাই আসুন একবার নয় বারবার এবং বারংবার আমরা পাঠ করি মহান মনিষীদের জীবনালেখ্য।

আরো পড়ুনঃ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা| একটি বিকল্প আরোগ্য বিধান|

এই লেখাটি আপনার উপকারে এসেছে কি? আরো নতুন লেখা তৈরির জন্য আর্থিকভাবে অবদান রাখতে পারেন। যেকোন পরিমাণ আর্থিক কন্ট্রিবিউশন  করতে নীচের ডোনেট বাটন ব্যাবহার করুন।

[custom_donation]

Previous articleঠোঁট ফাটা প্রতিরোধের উপায়: কারণ, লক্ষণ ও জটিলতা
Next articleঅ্যালকালয়েড কি? অ্যালকালয়েড এর বিস্তারিত
Dr. Dipankar Mondal
হোমিওপ্যাথিক নীতি অনুযায়ী রোগীর সামগ্রীক লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা দ্বারাই জটিল, কঠিন ও দুরারোগ্য রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব। জীবনযাপনের ভুল অভ্যাস থেকে সৃষ্ট রোগ, সংযম ব্যতীত শুধুমাত্র ঔষধ সেবনের দ্বারা প্রতিরোধ বা আরোগ্যের আশা করা বাতুলতা মাত্র।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here